ঢাউস বৈঠকখানায় বসে তিনি বলছেন“পোনা মাছের ঝোল, পোস্তর বড়া আর রসুন দিয়ে একটু লালচে শাক। ব্যস! চাহিদা বলতে এটুকুই। দাদা যে কী তৃপ্তি করে খেতেন!”
তিনি মুক্তিপ্রসাদ ধর। বছর সাতেক ধরে তিনিই ছিলেন ‘দাদা’র স্থানীয় অভিভাবক। এই ক’বছরে ‘দাদা’কে আপাদমস্তক চিনেছেন মুক্তিবাবু।
পাক্কা তিরিশ দিন আগে গোঁসা করে তৃণমূলে নাম লেখাল কী হবে, দাদার ছেড়ে যাওয়া আসনে কংগ্রেস প্রার্থী অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ের পাশে রয়েছেন তিনি। কোনও রাখঢাক না-করেই বলছেন, “নতুন দলে (তৃণমূল) আমার বয়স তো সবে এক মাস। এত তাড়াতাড়ি দাদার ছায়া থেকে সরে আসা যায়!” তৃণমূল নেতৃত্বের ছাড়পত্র নিয়েই অভিজিৎবাবুর হয়ে তাই প্রচার করছেন মুক্তি।
আশ্বিন মাসের চড়া রোদ্দুরে বাবার প্রলম্বিত ‘ছায়া’য় রোড-শো সেরে অভিজিৎবাবুও বলছেন, “এই প্রান্তিক জঙ্গিপুরের জন্য বাবা যা করেছেন, তার ফিরিস্তি না হয় না-ই দিলাম। তবে অনেক কাজ বাকি আছে। সেগুলো শেষ করার দায়িত্ব তো আমার। জঙ্গিপুর তা জানে।”
রঘুনাথগঞ্জ শহরের প্রান্তে বিঘা আটেক জমির উপরে পেল্লাই প্রাসাদটা বড় শখ করে তৈরি করেও শেষ পর্যন্ত গৃহপ্রবেশ হয়ে ওঠেনি তাঁর বাবার। অজস্র সোনাঝুরির চারা আর বাড়ির পিছনে একটা কিচেন-গার্ডেন সে সবের দেখভাল যে তাঁর উপরেই বর্তাচ্ছে, মৃদু হেসে তা মেনে নিচ্ছেন অভিজিৎ। বলছেন, “বাবার ছায়া রয়েছে এগুলোর উপরেও! জিতে আসি, তার পরে এগুলোও সাজিয়ে তুলব।”
কংগ্রেসের শক্ত বলয় মুর্শিদাবাদে তাঁর বাবা কিংবা মুক্তিবাবুর ‘দাদা’র এই ছায়াটাই এ বার বিজেপি-রও মস্ত হাতিয়ার! |
জঙ্গিপুর কেন্দ্রে উপনির্বাচনে বিজেপি প্রার্থী সুধাংশু বিশ্বাসের প্রশ্ন, “ছায়ায় ছায়ায় কী নির্বাচন জেতা যায়? লড়াইটা হয় মাঠে-ময়দানে!” বিজেপি-র সেই রাজনৈতিক লড়াইয়ের ময়দান আহিরণের তিনটি গ্রাম, জলঙ্গাপাড়া, রসুনপুর আর বাঙাবাড়ি। আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের উঁচু পাঁচিলের পাশে গ্রামগুলো প্রায় খাঁ খাঁ করছে। কেন? রসুনপুরের হিরন্ময় সরকার বলেন, “পুলিশের ভয়ে গ্রামের অধিকাংশই ঘর-ছাড়া। আমাদের চাষের জমি অধিগ্রহণ করেই ক্যাম্পাস উঠল। আবাদি জমি চেয়ে আমরা সরব হতেই পুলিশ গ্রামে গ্রামে হানা দিতে থাকল। কে থাকবে বলুন!”
তিন গ্রামের ২৪৬৯টি পরিবার ক্যাম্পাসের প্রায় সাড়ে চারশো বিঘা জমিতে বছরে দু’তিনটে ফসল বুনতেন। এখন তাঁরা কেউ দিনমজুর, কেউ বা জোগাড়ের কাজ করেন। বাঙাবাড়ির অমর ঘোষ বলেন, “ক্যাম্পাস তো হল, আমরা খাব কী? আমাদের আন্দোলনের পাশে কংগ্রেস বা সিপিএম কোনও দলেরই ছায়া নেই। আছে শুধু বিজেপি।”
ওই তিন-গ্রামের এই দাবিগুলো নিয়েই তাদের ভোট-ব্যাঙ্কে প্রচার চালাচ্ছে বিজেপি। মুর্শিদাবাদ জেলা বিজেপি-র এক নেতার ব্যাখ্যা, “আলিগড় ক্যাম্পাস গড়া নিয়ে সরাসরি সমস্যায় পড়েছেন তিন-চারটি গ্রামের বাসিন্দা। কিন্তু তাঁদের দাবিতে সাড়া দিয়েছে অন্য হিন্দু-প্রধান এলাকাও। যার সুফলটা বিজেপি পাবে।” গত বিধানসভা নির্বাচনে জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্রের ৭টি বিধানসভায় বিজেপি প্রায় ৪৫ হাজার ভোট পেয়েছিল। অলিগড়ের ছায়ায় এ বার তা দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে বলে বিজেপি-র দাবি।
পাল্টা আন্দোলনও রয়েছে। আলিগড় ক্যাম্পাস গড়ার দাবি নিয়ে জঙ্গিপুরের গাঁ-গঞ্জে প্রবল প্রচার চালাচ্ছে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি অফ ইন্ডিয়া (এসডিপিআই) এবং ওয়েলফেয়ার পার্টি অফ ইন্ডিয়া। ‘সুবিচার, স্বাধীনতা এবং সাম্যে’র কথা সামনে রাখলেও ওই দুই দলের এক নম্বর দাবি, ‘লক্ষ্য আলিগড় ক্যাম্পাস।’ গত বিধানসভা নির্বাচনে এসডিপিআই জঙ্গিপুরের পাঁচটি কেন্দ্রে প্রার্থী দিয়ে ভোট পেয়েছিল প্রায় ২৩ হাজার। এসডিপিআই নেতা তায়েদুল ইসলাম এ বার তার চেয়ে অনেক বেশি ভোটের প্রত্যাশায়। |
আলিগড়ের ক্যাম্পাস নিয়ে এই আন্দোলন এবং পাল্টা আন্দোলনের ছায়াতেই বুক বেঁধেছে সিপিএম। দলীয় সূত্রের ব্যাখ্যায়, বিজেপি এবং এসডিপিআইয়ের ভোট-কাটাকাটিতে আখেরে লাভ হবে তাদেরই। বাঁধা ভোটের বাইরে যে মানুষগুলো এত দিন স্রেফ মুক্তিবাবুর ‘দাদা’র নাম-মাহাত্ম্যে কংগ্রেসকে ভোট দিতেন, তাঁরা এ বার বিজেপি কিংবা এসডিপিআইয়ের দিকেই ঝুঁকবেন বলে মনে করছে সিপিএম। দলের মুর্শিদাবাদ জেলা সম্পাদক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্যের কথাতেও সেই ইঙ্গিত, “নির্বাচনের নানা অঙ্ক থাকে। আমরা সব অঙ্কেই এগিয়ে।”
নির্বাচনের ঠিক আগে দলীয় নেতার খুনের ঘটনায় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের রাজনীতির অভিযোগও তুলতে পারছে সিপিএম। দলের প্রার্থী মোজাফ্ফর হোসেনের কথায়, “জয় সম্পর্কে আমরা যথেষ্ট আশাবাদী। সন্ত্রাস সৃষ্টির চেষ্টা চলছে। গত ৮ বছর কোনও কাজ হয়নি। দ্রব্যমূল্য লাগামছাড়া। মানুষ এটা বুঝেছেন।”
নিজেরা প্রার্থী না-দিলেও সিপিএমের অঙ্কে আশা জোগাচ্ছে তৃণমূলও। সরাসরি না-হলেও কংগ্রেস প্রার্থীর পাশে মুক্তিবাবু ছাড়া বড়-মেজ, কোনও তৃণমূল নেতাকেই দেখা যাচ্ছে না!
তৃণমূলের জেলা সভাপতি মহম্মদ আলি স্পষ্টই বলছেন, “উপনির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থীর পাশে দাঁড়ানো কিংবা তাঁর বিরোধিতা কোনও নির্দেশই আমাদের কাছে নেই।” তবে জঙ্গিপুরের স্থানীয় এক প্রভাবশালী তৃণমূল নেতার অভিযোগ, “জোট থাকাকালীন কংগ্রেস আমাদের সঙ্গে কোনও ব্যাপারেই সামান্যতম আলোচনা করার সৌজন্য কখনও দেখায়নি। এখন তো সে প্রশ্নও নেই।” দলের স্থানীয় নেতারা অনেকেই তা নিয়ে কিঞ্চিৎ ক্ষুব্ধ। এই ক্ষোভেই অনেকেই গাঁ-গঞ্জে কংগ্রেস বিরোধী প্রচার করছেন। বক্তব্য, আর যা-ই হোক ভোটটা যেন কংগ্রেসের বোতামে না পড়ে। ক্ষেত্র বিশেষে তা বিজেপি, এমনকী এসডিপিআই হলেও ক্ষতি নেই। সেই ভোট কি সিপিএমের চিহ্নেও পড়তে পারে? মুচকি হেসেছেন তৃণমূলের ওই নেতা।
তবে এই ‘ছায়াচ্ছন্ন’ অঙ্কের বাইরে সব দলেরই কপালে ভাঁজ ফেলেছে উপনির্বাচনের নির্ঘণ্ট। সামনেই পুজো। তার পরেই ২৬ অক্টোবর কুরবানির ঈদ। কর্মসূত্রে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়া মানুষ শারদোৎসব কিংবা ঈদের সময়ে গ্রামে ফেরেন। তার আগে বুধবার, উপ-নির্বাচনের সকালে স্রেফ ভোট দিতে তাঁরা কী ‘দেশে’ ফিরবেন? প্রশ্নটা ভাবাচ্ছে।
আর তিনি, রাইসিনা হিলসে পাড়ি-দেওয়া, মুক্তিবাবুর ‘দাদা’, প্রণব মুখোপাধ্যায়?
মৃদু হেসে মুর্শিদাবাদে কংগ্রেসের কারিগর অধীর চৌধুরী বলছেন, “ছায়াই ভরসা মশাই! প্রেসিডেন্ট ইজ ভেরি মাচ ইন দি ইলেকশন!” |