প্রবন্ধ ২...
তাঁর সঙ্গে তর্ক করেই আমাদের যাত্রা শুরু
ত শতাব্দীর ষাট-সত্তরের দশক ছিল মার্ক্সবাদী ও সাধারণ ভাবে বামপন্থী ইতিহাসচর্চার স্বর্ণযুগ। যে তিন ইংরেজি-ভাষী ইতিহাসবিদের রচনা সেই যুগে বিশ্ব জুড়ে সমাদৃত হয়েছিল, তাঁরা হলেন এডওয়ার্ড টমসন, এরিক হবস্বম, ক্রিস্টোফার হিল। টমসন আর হিল আগেই গত হয়েছেন। এ বার চলে গেলেন হবস্বম। একটি যুগের অবসান হল।
হবস্বমের কৌতূহল ও আগ্রহের সীমা ছিল বহু-বিস্তৃত। অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যে সব ধারা বয়ে গিয়েছে পশ্চিমি ইতিহাসে: রাষ্ট্রনৈতিক বিপ্লব, শিল্প বিপ্লব, শ্রমিক শ্রেণি ও নিচু তলার মানুষের সামাজিক অভ্যুত্থান, সোভিয়েত বিপ্লব, ফ্যাসিবাদ, নাত্সিবাদ, বিশ্বযুদ্ধ হয়ে একেবারে হাল আমলের বহু কথিত বিশ্বায়ন কিছুতেই তাঁর আগ্রহের কমতি ছিল না। বিশেষ আগ্রহ ছিল যাকে তিনি ‘দ্য লং নাইনটিন্থ সেঞ্চুরি’ বা ‘দীর্ঘ উনিশ শতক’ বলতেন, তার ইতিহাসে। এ ছাড়াও ছিল মার্ক্সবাদী তত্ত্বে এবং ঐতিহাসিক গবেষণার পদ্ধতি ও তত্ত্ব আলোচনার আগ্রহ। ইতিহাসের উত্তর-আধুনিক তত্ত্বের প্রভাবের বিরুদ্ধেও হাতিয়ার ধরেছিলেন হবস্বম তাঁর ‘অন হিস্ট্রি’ গ্রন্থে। আবার এই মানুষটিই অন্য দিকে ‘ফ্রান্সিস নিউটন’ ছদ্মনামে ‘নিউ স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় বছরের পর বছর জ্যাজসংগীত নিয়ে আলোচনা করে গিয়েছেন। সে বিষয়ে দু’টি বইও আছে তাঁর। বহু দিন পর্যন্ত লোকে জানত না, বিপ্লবী-মার্ক্সবাদী ইতিহাসবিদ হবস্বম ও জ্যাজ-বিলাসী ফ্রান্সিস নিউটন একই মানুষ! সব মিলিয়ে তিরিশের বেশি বই লিখেছিলেন তিনি।
জীবনের শেষে অনেক সম্মান কুড়োলেও মার্ক্সবাদী বীক্ষার প্রতি অবিচল আনুগত্যের জন্য খেসারত দিতে হয়েছে এই ইতিহাসবিদদের। হিল অক্সফোর্ডে পড়াতেন ঠিকই, কিন্তু এক সময় ভিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পদ তাঁকে দেওয়া হয়নি তাঁর মার্ক্সবাদী বিশ্বাসের কারণে। কৌলীন্যবোধে গর্বিত অক্সফোর্ড-কেমব্রিজ জায়গা করে দেয়নি হবস্বম-টমসনকে। টমসন পড়িয়ে গিয়েছেন ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে তাঁকে কোনও দিন ‘ফুল প্রফেসরশিপ’ দেওয়া হয়নি। হবস্বমের কেমব্রিজে চাকরি একদা আটকে দেওয়া হয়েছিল। লন্ডনের বার্কবেক কলেজে, যেখানে তিনি দীর্ঘকাল অধ্যাপনা করেন, সেখানেও বহুদিন তাঁর ‘পূর্ণ’ (ফুল) অধ্যাপক পদে প্রমোশন আটকে ছিল। তাতে দমেননি এই মহারথীরা। ১৯৫২ সালে সাধারণ মানুষের ইতিহাস লেখার জন্য হবস্বম, টমসন, হিল ও অন্যান্য বন্ধুরা মিলে ‘পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট’ নামে যে পত্রিকাটির স্থাপনা করেন, আজও তা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গবেষণা-পত্রিকা বলে সম্মান পায়। আজ যখন চার পাশে এই মহারথীদের তুলনায় অনেক নিম্নমানের গবেষকদের তড়িঘড়ি পদোন্নতির জন্য লোভাতুর ও স্বার্থসন্ধানী ব্যবহার দেখে মন খারাপ হয়ে যায়, তখন নিছক মন-ভাল-করার প্রয়োজনেই স্মরণ করি এই ইতিহাসবিদদের বিশ্বাস, কল্পনা, সৃষ্টিশীলতা ও সৎ পরিশ্রমকে পুঁজি করেই যাঁরা প্রতিষ্ঠানকে বুড়ো আঙুল দেখানোর হিম্মত রেখেছেন। (হাতের কাছে দিশি উদাহরণ রণজিৎ গুহর কথাও এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে।)
হয়তো নিজের জীবনের নানান সময়ের বিভিন্ন টালমাটালই হবস্বমকে তাঁর নিজস্ব প্রত্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। সোভিয়েত বিপ্লবের বছরে তাঁর জন্ম, আলেকজান্দ্রিয়ায়, মিশরে। পিতৃকূলের আদি বাড়ি পোল্যান্ড। মাতৃবংশ ইহুদি, অস্ট্রিয়াবাসী। অল্প বয়সে মা-বাবাকে হারিয়ে বড় হন আত্মীয়ের কাছে, বার্লিনে। বড় হতে না হতেই শুরু হিটলারি তাণ্ডব। চোদ্দো বছর বয়সে কমিউনিস্ট সংগঠনে নাম লেখান হবস্বম। কিছু দিন বাদে আবার ইংল্যান্ড। তাঁর দীর্ঘজীবনে দেখা পৃথিবীর নানা পরিবর্তন সোভিয়েত দুনিয়ার উত্থান ও পতন। নাত্সিবাদ, ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মানুষের মরণজয়ী লড়াই, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ (যাতে তিনি অংশ নেন), ঠান্ডা যুদ্ধ, বিশ্বায়নের নামে ধনতন্ত্রের ‘খাই-খাই’ সমাজ-ব্যবস্থা: এই পরিবর্তনশীল দুনিয়ায় তিনি পায়ের নীচে জমি পেয়েছিলেন প্রত্যয়ের ভূমিতে। ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টি যত দিন ছিল, হবস্বমও তার সদস্য ছিলেন তত দিনই। এ ব্যাপারে তিনি টমসন ও হিলের থেকে ভিন্ন চরিত্রের মানুষ।
অটল বা অনড় বিশ্বাস যে সব সময়ের মানুষের বুদ্ধিকে স্বচ্ছ করে তোলে, এমন দাবি করছি না। ১৯৯৪ সালে একটি সাক্ষাৎকারের চাপে পড়ে এমন কথাও বলেন হবস্বম যে, যদি সত্যিই একটি যথার্থ কমিউনিস্ট সমাজ গড়া হত রুশ দেশে, তা হলে স্তালিনের সব অপরাধ ক্ষমার যোগ্য হত! হবস্বমের এই উক্তির সমর্থনে আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু তাঁর প্রত্যয়ের মূলে যে মূল্যবোধ আছে, তা সর্বাংশে শ্রদ্ধেয়। সোভিয়েত বিপ্লব তাঁর মনে একটি আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছে, যা কোনও দিনই নেভেনি। এই উক্তি হবস্বমেরই। কী সেই আশা? মানুষ এক দিন শুভবুদ্ধি ও ক্ষমতা ব্যবহার করে ন্যায়সঙ্গত ও সহৃদয় সমাজব্যবস্থা তৈরি করবে।
সাম্প্রতিক ভারতীয় ইতিহাসের নানা ধারার আলোচনা করতে গেলে হবস্বম খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন। রণজিৎ গুহর নেতৃত্বে ‘সাবঅলটার্ন স্টাডিজ’ বা ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’ রচনার যে ধারাটি যুবা বয়সে, ১৯৮০-র দশকে, আমরা ক’জনা চালু করেছিলাম, তার গোড়াতেই দাঁড়িয়ে আছেন হবস্বম। তাঁর সঙ্গে তর্ক করেই আমাদের যাত্রা শুরু। তাঁর বিখ্যাত বই ‘প্রিমিটিভ রেবেলস’-এ (১৯৫১) তিনি লেখেন যে, তৃতীয় দুনিয়ার যে সাম্রাজ্যবাদী গণ-আন্দোলনের ফলে ইউরোপীয় ‘প্রভু’রা উপনিবেশ ছাড়তে বাধ্য হন, সেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ-কারী কৃষক বা আদিবাসী মানুষের চেতনা ছিল ‘প্রাক-আধুনিক’ বা তাঁর ভাষায় ‘আদিম’ বা ‘প্রিমিটিভ’। আমরা মানিনি কথাটি। বিদ্রোহী কৃষকের ও আদিবাসীর চেতনার রাজনৈতিক চরিত্র সন্ধানই ছিল আমাদের গবেষণার উপজীব্য বিষয়। তর্কাতর্কিতে কিন্তু হবস্বমের একটি মূল কথা হারিয়ে গিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন যে, বিংশ শতাব্দীই সবচেয়ে বিপ্লবী শতক, কারণ এই শতকেই কৃষক ও আদিবাসী মানুষকে আধুনিক রাষ্ট্রের সঙ্গে তার আওতার মধ্যে থেকেই বাইরে থেকে নয় যুঝতে হয়েছে। হবস্বমের এই কথাটি আমার গভীর ভাবে সত্য মনে হয়।
আমার পিএইচ ডি থিসিসের অন্যতম পরীক্ষক ছিলেন হবস্বম। পরীক্ষার পর আমায় একটি চিঠিতে লেখেন, ‘তোমার প্রয়োজন হলে আমি খুশি হয়েই তোমার জন্য সুপারিশপত্র লিখব।’ ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল না, তাই কিছু চাইনি কোনও দিন। তা ছাড়া শুনেছিলাম দেশের বন্ধুরা তাঁকে বুঝিয়েছেন যে, ‘সাবঅলটার্ন স্টাডিজ’ পরোক্ষে হিন্দুত্ববাদীদেরই মদত দেয়, ও উনি নাকি ‘সাবঅলটার্ন’দের ওপর খাপ্পা। তাই ভাব জমানোর উৎসাহ হয়নি। ভেবেছিলাম, কী জানি, মানুষটা যদি কানপাতলা হন! কয়েক বছর আগে লন্ডনে বার্কবেক কলেজে বক্তৃতা করতে গিয়েছি। বক্তৃতার শেষে এক দীর্ঘদেহী বয়স্ক মানুষ আমায় কিছু প্রশ্ন করলেন। পরে কাছে এসে করমর্দন করে বললেন, ‘প্রফেসর চক্রবর্তী, আমার নাম এরিক হবস্বম।’ আমি কী বলব? অমন বিদ্বান মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানানো ছাড়া আর কী-ই বা করার আছে। তাঁর মৃত্যুতে সে কথাই নতুন করে মনে হল। মানুষটি বিদ্যায়, বীক্ষায় বড় মাপের ছিলেন। আমার চেনাশোনা জগতে এমন মানুষ ক্রমশই বিরল হয়ে উঠছেন।

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.