আনন্দবাজার পত্রিকায় দু’-দুটি উত্তর-সম্পাদকীয় লেখা পড়লাম জাতপাতের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বিষয়ে। অধ্যাপক শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন কেমন করে গত কয়েক দশকে উত্তর ভারতীয় রাজনীতিতে উপরতলার ক্ষমতা বিন্যাসে একটা মৌলিক পরিবর্তন এসেছে, যাতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে কেবল নৈর্ব্যক্তিক উন্নয়নের ভাষাতে আর ভোটের ঝুলি ভরে না। সংসদীয় রাজনীতির ভাষাটাই আগাগোড়া বদলে গিয়েছে। তাঁর সঙ্গে দ্বিমত হওয়া মুশকিল। পড়ে ভাল লাগল যে উনি নিজের পুরনো গবেষণার সিদ্ধান্তগুলিকেও নতুন রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতের আলোকে খানিকটা পরিমার্জন করেছেন। ২০০৪ সালে প্রকাশিত একটি বইতে উনি বলেছিলেন দলিত রাজনীতি উচ্চবর্ণের তথা উচ্চজাতির স্বার্থবাহী দলগুলির সাথে একধরনের সমঝোতা না করে রাজনৈতিক স্বকীয়তায় আসতে পারে না। অর্থাৎ মূলস্রোতের ভোটাভুটির ভাষা মূলত তখনও পর্যন্ত উচ্চবর্ণ স্বার্থবাহী শক্তিগুলি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। মনে পড়ছে সেই বইটির উপজীব্য ছিল বাংলার জাতপাতের সংস্কৃতি। সেই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি পরের বইয়ের (যেখানে মণিকুন্তলা সেন-এর আত্মজীবনীর উল্লেখ করা হয়েছে) মূল বক্তব্যে একটা সূক্ষ্ম বদল করেছেন। বলছেন যে এক সময়ে বাংলার রাজনীতিতে জাতপাতের ভাষা কমজোরি হয়ে গেলেও ইদানীং সেটি আবার জনমতের বলিষ্ঠ দিক হয়ে পড়ছে। দ্বিতীয় লেখাটি গৌতম রায়ের, যিনি লিখেছেন উত্তর ভারতের জাতপাতের রাজনীতির অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ নিয়ে। এই দুটি লেখার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলার জাতপাতের রাজনীতির ভাষা নিয়ে কয়েকটি কথা বলতে চাইছি।
অধ্যাপক বন্দ্যোপাধ্যায় স্বীকার করেছেন যে উত্তর ভারতে মূলস্রোতের রাজনীতির কথোপকথনে (ভাষার পরিবর্তন কথোপকথনেই আসে) একটা মৌলিক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে যার পরিপ্রেক্ষিতে কমিউনিস্ট-দের রাজনৈতিক চিন্তাধারার একটা বদল প্রয়োজন। গৌতমবাবুও সে কথাই প্রকারান্তরে বলেছেন। তবুও কোথাও যেন এই লেখাগুলো পড়ে মনে হয় এঁরা অন্য কোনও জায়গার কথা বলছেন, যেন পশ্চিমবঙ্গে বিষয়টা এখনও ততটা জরুরি নয়। অধ্যাপক বন্দ্যোপাধ্যায় মণিকুন্তলা সেনের লেখার কথা বলেছেন, যোগেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের কথাও লিখেছেন, (যদিও যোগেন্দ্রনাথ কী অর্থে সমাজ-সংস্কারক সেটা পরিষ্কার নয়), বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের নেহরু-সুলভ ভঙ্গিতে জাতপাত জিনিসটাকে একটা আধুনিকতাবিরোধী প্রভাব হিসেবে অপছন্দ করার কথাও বলেছেন। বলেছেন যে বাঙালি ব্রাহ্মণ কায়স্থরা নাকি জাতগোত্রের বাইরে গিয়ে চিন্তাভাবনা করতে পেরেছেন। কথাটা অংশত ঠিক, সবটা নয়। আনন্দবাজার পত্রিকার সাম্প্রতিক লেখা থেকেই উদাহরণ দেওয়া যাক। প্রণব মুখোপাধ্যায় যখন রাষ্ট্রপতি হলেন, বেশ কিছু প্রবন্ধে তিনি যে কীর্ণাহারের ‘ব্রাহ্মণ সন্তান’, সেই কথাটি বার বার মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে। কথা এই যে, ওঁর ব্রাহ্মণত্বের সাথে রাষ্ট্রপতি হওয়ার সম্পর্কটা ঠিক পরিষ্কার নয়। যদি উনি কামার বা কুমোর হতেন তাহলেও কি এ ভাবে কথাটা লেখা হত? কিংবা যদি জুগি অথবা ধোপা হতেন? |
প্রশ্নটা এই যে, বাংলার রাজনীতিতে জাতপাত এসেছে না আসেনি। বাংলার মানুষ কি বিষয়টাকে কেবল একটা উত্তর ভারতীয় ‘গোলমাল’ হিসবেই দেখে চলেছেন এবং চলবেন? মণিকুন্তলা সেন-এর আত্মজীবনীর উল্লেখ করে অধ্যাপক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন যে বাংলার রাজনীতিতে জাতপাত আদৌ ব্রাত্য নয়, অনেক বছর আগে প্রকাশিত সুশীল ধাড়ার আত্মজীবনীতেও রয়েছে ১৯৬৭ সালের ভোটাভুটির প্রচারকালে নদিয়ার শরণার্থী শিবিরের মানুষের কোনও ‘স্বজাতি’র মানুষকে উঁচু পদে দেখার বাসনার কথা। মণিকুন্তলা সেন বা সুশীল ধাড়া যাদের কথা বলেছেন তারা নমঃশূদ্র অথবা রাজবংশী নয়। অন্যত্র অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন যে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলার রাজনীতিতে জাতপাতের ভাষা ততটা জোরালো না হওয়ার কারণ হল ভদ্রলোক বাঙালির ‘ভূমিহীন’ হয়ে পড়া। আসলে স্বাধীন বাংলার রাজনীতিতে জাতপাত কতখানি এসেছে এবং কী ভাবে সে বিষয়ে কাজকর্ম এখনো ততটা শুরু হয়নি। আমরা কত জন জানি যে পঞ্চাশ এবং ষাট-এর দশকে বাংলার প্রথম এবং দ্বিতীয় বৃহত্তর দুটি হিন্দু জাত বেশ কয়েক বার একটা রাজনৈতিক জোট গড়ার চেষ্টা করে? ১৯৬৭ সালের ভোটাভুটির পূর্ণ ইতিহাস এখনো লেখা বাকি। বাংলা কংগ্রেস নিয়ে পড়াশোনা এখনও শৈশবে। সম্প্রতি মতুয়া সম্প্রদায় যে ভাবে ভোটের রাজনীতিতে এসেছে তাকে কী ভাবে ব্যাখ্যা করব, সেই প্রশ্নও ওঠা দরকার। এই বিষয়ে সবচেয়ে বড় বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই।
আমরা জানি যে, শিক্ষিত মাস্টারমশাই ধনী ব্যবসায়ীর থেকে বেশি সম্মাননীয়। কিন্তু, কেন? এক জন সফল ব্যবসায়ী এক জন সফল শিক্ষকের চেয়ে বেশি শ্রদ্ধেয় কেন? দুজনেই যদি নিজের কাজটা নিষ্ঠাভরে করেন তাহলে তাদের সম্মানে হেরফের কেন? একই ভাবে সম্পন্ন চাষীদের ক্ষেত্রেও প্রশ্নটা তোলা যায়। আসলে সমস্যাটা কোথাও আমাদের সংস্কৃতিক ইতিহাস ও রাজনীতির আদানপ্রদানের মধ্যে লুকিয়ে আছে। এর প্রতিফলন সব সময় ভোটাভুটিতে সরাসরি ভাবে হয় না, হবেও না। বরং বাংলা সাহিত্যে আড্ডায় ঠাট্টায় অনেক বেশি জাতপাত লুকিয়ে থাকে, আর আমরা সে দিকে তাকাতে সময় পাই না। বাংলায় জাতপাতের রাজনৈতিক প্রকাশ তাই খুঁজতে হবে আমাদের লেখাপড়ায়, পেশায়, প্রকাশভঙ্গিতে, আত্মবিশ্বাসে, বিশ্বাসে।
আর এই বারে, শেষে, সবচেয়ে গোড়ার কথাটি বলা যাক। আমাদের লেখাপড়া বলে ব্যক্তিগত জীবনে যেমন ধরুন বিয়ের ক্ষেত্রে মানুষ জাতবিচার মানলে নাকি তেমন দোষ নেই, কিন্তু জনপরিসরে যেমন ধরুন, চাকরি অথবা ভোটভিক্ষেযদি জাতপাতের প্রসঙ্গটি এসে যায়, সেটি অত্যন্ত অনভিপ্রেত। আমার মনে হয়, ব্যক্তিপরিসর বনাম জনপরিসর এই ভাগাভাগি ব্যবহারিক ক্ষেত্রে অনেক সময় রাখা যায় না। ঠিক সেই কারণেই আমাদের এই দুই পরিসরের মাঝামাঝি জায়গাগুলো--মানে সাহিত্য, আড্ডা, বেখেয়াল কথাবার্তাকে আরও সাবধানে খেয়াল করা দরকার। ব্রাহ্মণ সন্তান রাষ্ট্রপতি হলে জনপরিসরে তাঁর জাতপাতের প্রসঙ্গটি আসে, ঝাড়ুদার বা জমাদার হলে আসে না, সেটা লক্ষ করা দরকার। কাগজে যদি পড়ি, শ্রীপঞ্চানন্দ মোদক, পশ্চিমবঙ্গের নতুন মুখ্যমন্ত্রী বহরমপুরের এক হতদরিদ্র মোদক বংশে জন্মগ্রহণ করেন এবং কালক্রমে অধ্যবসায়ের জোরে এক সুবিশাল মিষ্টান্ন সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন? এমন একটা চরিত্রকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ভালো লাগবে আমাদের? কিংবা, খবর হিসেবে পছন্দ করব আমরা? আসলে আমাদের ভেতরকার প্রেজুডিস-গুলো কেবল প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির পরিসরে ধরা যায় না!
অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, দিল্লি |