এই মুহূর্তে বিদেশি পুঁজির আবির্ভাব এতটাই আলোড়ন তুলেছে যে, এই প্রথম কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্যে প্রধানমন্ত্রীর বাচনভঙ্গি নকল করে দেখালেন। এই প্রথম কোনও প্রধানমন্ত্রী ‘জাতির উদ্দেশে’ ভাষণ দিতে গিয়ে জনগণকে প্রায় ধমকে বললেন, ‘টাকা তো আর গাছে ফলে না!’ আমরা সচকিত। রাজনৈতিক সচেতনতার তুঙ্গে বসবাসকালে গায়ে চিমটি কেটে নিজেদের জাগিয়ে রাখছি নিয়ত। নয়তো কোনও মহান দৃশ্য ফট করে মিস করে যেতে পারি।
আঞ্চলিক থেকে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলির এই যখন-তখন অবস্থানগত পরিবর্তন আমাদের বিস্মিত করে। যে বিজেপি-র নেতৃত্বাধীন এনডিএ-র শাসনকালে আস্ত একটা ‘বিলগ্নিকরণ’ মন্ত্রক ছিল এবং যে মন্ত্রক পূর্ববর্তী কংগ্রেস জমানার তুলনায় অধিকতর তীব্রতার সঙ্গে আর্থিক সংস্কার চালিয়েছিল, সেই বিজেপিই মনমোহিনীয় অর্থনীতির বিরুদ্ধে ভারত বন্ধ ডাকছে। তদানীন্তন এনডিএ জমানার অন্যতম শরিক তৃণমূল কংগ্রেস আর্থিক সংস্কারের বিরুদ্ধে লাগাতার সোচ্চার। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী টিকায়েত বা হজারের স্টাইলে রাজধানীর রাজপথে নেমে পড়ছেন প্রতিবাদ করতে। জনপরিসরে আলোচনা চলছে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রকৃত পরিচিতি সত্তা নিয়ে। এই দলটির তীব্র কোনও মতাদর্শগত ভিত্তি নেই। সামাজিক আত্তীকরণের মাধ্যমে এর ব্যাপ্তি, আত্তীকরণের কারণেই এর অস্থিরতা, সংখ্যালঘু দরদ, ‘মতুয়া’ধর্মিতা কিংবা আর্থিক সংস্কার-বিরোধী স্লোগানমুখর বামপন্থা ইত্যাদি নানাবিধ পরিচিতিকে এক সূত্রে বেঁধে ফেলা যথেষ্ট কঠিন কাজ। |
আরও কঠিন, কারণ এগুলির জন্য যে সুদীর্ঘ ধারাবাহিক সামাজিক অভিনিবেশ প্রয়োজন, তা অনুপস্থিত। অর্থাৎ, পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণের জন্য সামাজিক বর্গগুলিকে সামনে নিয়ে আসা ও গুরুত্ব দেওয়া ওই রাজনৈতিক অবস্থানের মতোই অস্থিতিশীল। বামফ্রন্টকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য সংখ্যালঘু ও মতুয়া পরিচিতি সত্তা, আবার কেন্দ্রে কংগ্রেসকে বিপাকে ফেলার জন্য কিংবা রাজ্যে বামেদের পালের হাওয়া কেড়ে নেওয়ার জন্য আর্থিক সংস্কারের চরমপন্থী বিরোধিতা প্রকৃতপক্ষে দলটির একটি আরোপিত সত্তাকে সামনে এনে দেয়। ভবিষ্যতে তৃতীয় ফ্রন্টের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস আসতেই পারে। কিন্তু তার জন্য যে সামাজিক সংযোগ দরকার, সেটা কোথায়?
অথচ কাল্পনিক সেই তৃতীয় ফ্রন্টের অন্যতম শরিক-দলের নেত্রী জয়ারাম জয়ললিতার সঙ্গে তৃণমূল নেত্রীর রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ ও নেতৃত্বের ধরনে যতই সাদৃশ্য থাক, তা একান্তই বহিরঙ্গে। এ কথা ঠিক যে, মমতার মতোই জয়ললিতাও তাঁর দলকে প্রায় একক ইচ্ছানুসারে পরিচালনা করেন। তিনিও অতীতে কখনও কংগ্রেস, কখনও বিজেপি-র সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। বর্তমানে তৃতীয় ফ্রন্টে নেতৃত্বের দাবিদার। কিন্তু তাঁর এই অবস্থান বদলের একটি ধারাবাহিকতা আছে, যা তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ ডিএমকে-র অবস্থান-সাপেক্ষে স্থির হয়। পশ্চিমবঙ্গে যেমন রাজনৈতিক অবস্থান সামাজিক বর্গগুলির পারস্পরিকতার ভিত্তিকে স্থির করে দিচ্ছে, তেমনই তামিলনাড়ুতে প্রাথমিক স্তরে সামাজিক আন্দোলনের অভিঘাতে রাজনৈতিক ভিত্তি প্রস্তুত হয়েছে। পরে রাজনীতি সমাজনীতিকে গ্রাস করেছে।
এ দেশের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সামাজিক অনুপ্রবেশের যে একটা প্রয়োজনীয়তা আছে, তা বিংশ শতকের প্রথমার্ধে তামিল রাজনীতিকদের একাংশ অনুভব করেছিলেন। রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সামাজিক ভিত্তি নির্মাণের জন্য তাঁরা সচেষ্ট হয়েছিলেন। এই কাজে প্রথমেই স্মরণীয় এরোড বেঙ্কট রামস্বামী নাইকার বা পেরিয়ার। জন্মসূত্রে কন্নড়ভাষী পেরিয়ার উপলব্ধি করেন যে, জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ক্ষেত্রেও কী ভাবে কংগ্রেসের ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতি উচ্চবর্ণকে নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত করে এবং উচ্চবর্ণের রাজনৈতিক ভাষাই হয়ে ওঠে প্রধান বক্তব্য।
১৯২৪ সালে গাঁধীজির ডাকে ভাইকম সত্যাগ্রহে যোগ দিয়ে পেরিয়ার বুঝতে পারেন যে, সামাজিক মুক্তি আন্দোলন ব্যতীত রাজনৈতিক বহিরঙ্গে পরিবর্তন আসবে না। সেই সূত্রে ১৯২৫-এ তিনি ‘আত্ম-মর্যাদা’র আন্দোলন শুরু করেন। ব্রাহ্মণ্যবাদ-বিরোধী এই প্রবল সামাজিক আন্দোলন তামিল জনমানসে এক তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করে। ব্রাহ্মণ্যবাদ-বিরোধী ওই সামাজিক আন্দোলনই জন্ম দেয় পৃথক রাজনৈতিক সত্তার। উচ্চবর্ণের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস দলের প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রথমে পেরিয়ারের দ্রাবিড় কাজাগাম এবং ১৯৪৯-এ পেরিয়ারের প্রধান শিষ্য আন্নাদুরাই-এর নেতৃত্বাধীন দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাজাগাম (ডিএমকে) জন্মলাভ করে। রাজনৈতিক ক্ষমতালাভ ডিএমকে-র লক্ষ্য হলেও প্রধান উদ্দেশ্য ছিল উচ্চবর্ণ নিয়ন্ত্রিত তামিল সমাজ বাস্তবতার পরিবর্তন। তাই দল গঠনের পরেই আন্নাদুরাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চাননি। ডিএমকে নির্বাচনী রাজনীতিতে যোগদান করে ১৯৫৭-এ। ১৯৬৭-তে রাজ্যে ক্ষমতা দখল করতে সমর্থ হয়। আশ্চর্য, ১৯৬৯-এ আন্নাদুরাই-এর আকস্মিক মৃত্যুর পর ডিএমকে যে অন্তর্দলীয় নেতৃত্বের সংঘাতে জড়িয়ে পড়ল, তা-ই পরবর্তী কালে তামিল রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করে দিয়েছে। দলের নেতৃত্বে উঠে এলেন করুণানিধি। শুধু ক্ষমতাদখলই নয়, তিনি দ্রাবিড় আন্দোলনের সামাজিক ভিত্তিকে প্রায় বিস্মৃত হয়ে ক্রমশ ডিএমকে’কে নিজের পরিবারের নিয়ন্ত্রণাধীন করে ফেললেন।
১৯৭২-এ তাই এম জি রামচন্দ্রনের নেতৃত্বে এআইএডিএমকে-র জন্ম স্বাভাবিক পরিণতি বলেই মনে হয়। মজার বিষয় হল, যে ডিএমকে থেকে এই নতুন দলের সৃষ্টি, সেই উৎসই হয়ে উঠল প্রধান প্রতিপক্ষ, এমনকী শত্রু। উচ্চবর্ণবাদী কংগ্রেস নেতৃত্বের প্রতি সমর্থন জানাল আন্নাদুরাই-এর নামাঙ্কিত নতুন দলটি। জরুরি অবস্থাও মেনে নিল। ১৯৭৭-এ ডিএমকে’কে পর্যুদস্ত করে ক্ষমতায় এল।
সেই থেকে ওই দুই দল তাদের সামাজিক ভিত্তি প্রায় বিস্মৃত হয়ে রাজনৈতিক সুবিধার্থে কখনও কংগ্রেস, কখনও বা বিজেপি-র হাত ধরেছে, অথচ পরস্পরের কাছাকাছি আসেনি। ব্রাহ্মণ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলন থেকে সরে এসে এআইএডিএমকে রামচন্দ্রনের উত্তরসূরি হিসেবে আয়েঙ্গার ব্রাহ্মণ-কন্যা জয়ললিতাকে নেতৃত্বে বরণ করে নিয়েছে। অর্থাৎ, বর্ণহিন্দুদের প্রতি যে-বিদ্বেষ থেকে দ্রাবিড় আন্দোলন ও রাজনীতির সূত্রপাত, তার আজ কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই। তামিল রাজনীতি বহিষ্কারের সামাজিক অবস্থানকে সংহত করে অন্তর্ভুক্তির রাজনীতিকে প্রাধান্য দিয়েছে, পাল্টে গেছে রাজনৈতিক অগ্রাধিকার এবং প্রতিপক্ষ।
পশ্চিমবঙ্গে দেশভাগজনিত প্রবল সামাজিক যন্ত্রণাও সে ভাবে সাম্প্রদায়িক বা জাতপাত-ভিত্তিক রাজনীতির জন্ম দেয়নি। এর একটা বড় কারণ জাতীয় কংগ্রেসের সর্বজনীন মান্যতা এবং প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রধানত কমিউনিস্টদের উপস্থিতি। কমিউনিস্ট রাজনীতি যাবতীয় সামাজিক বর্গগুলিকে শ্রেণিসত্তার গর্ভে বিলীন করে দিতে পেরেছিল।
তৃণমূল কংগ্রেস সামাজিক বর্গগুলিকে আজ প্রধান করে তুলেছে। কিন্তু তা নতুন কোনও সামাজিক আন্দোলন ছাড়াই মূলত রাজনৈতিক দলীয় প্রেক্ষাপটে আবদ্ধ। এর ফলে ওই বর্গগুলির আচরণে ও দাবিদাওয়ার মধ্যে কোনও সুসংহত রূপ দেখা যাচ্ছে না। নেই কোনও বিশেষ রাজনৈতিক অগ্রাধিকারও। রাজনৈতিক অভিনিবেশ থাকবেই বা কী ভাবে? যে সি পি এম-বিরোধিতার তরণীতে ভাসমান রাজনীতি একটি প্রবাহ সৃষ্টি করেছিল, তা হঠাৎ দিক পাল্টে কমিউনিস্টদের স্লোগানগুলিকে আত্মসাৎ করতে চায়। আঞ্চলিক থেকে জাতীয় হয়ে ওঠার জন্য বদলে যায় প্রতিপক্ষ, কিন্তু সেই বিশেষ রাজনীতির কোনও ধারাবাহিকতা গড়ে ওঠে না। শুধুমাত্র নির্বাচন-নির্ভর এক প্রকার সামাজিক সচলতা তৈরি হয় মাত্র।
দ্রাবিড় আন্দোলনের দুই সন্তান আজ একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী। সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসর তাদের দখলে। দু’দলের নেতৃত্বের ধাঁচে তৃণমূল কংগ্রেসের সঙ্গে সাদৃশ্য থাকলেও তা বহিরঙ্গে। সামাজিক, রাজনৈতিক ধারাবাহিকতার স্থিতিশীল ঐতিহ্য নেই যে, উত্তরণ ঘটিয়ে নতুন অবস্থান নির্মিত হবে। তাই মনে হয়, সামাজিক বর্গ-নির্ভর বা বামপন্থী কোনও অবস্থানই স্থায়ী সামাজিক ভিত্তির জন্ম দেবে না।
বঙ্গবাসী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক |