মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংখ্যালঘু-নীতিকে আক্রমণ চলছে। আবার রাজ্যে দলের প্রথম সারির নেতা তথা প্রাক্তন মন্ত্রীকে হজে যাওয়ার অনুমতিও দেওয়া হচ্ছে! উল্টো দিকে, খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) প্রতিবাদ-মঞ্চে বিজেপি-র সঙ্গে এক মঞ্চে হাজির হয়ে যাচ্ছেন দলের পলিটব্যুরোর সদস্য!
এই ত্র্যহস্পর্শে ফের তীব্র ধর্ম-সঙ্কটে পড়েছে সিপিএম! দলের নীতি ঠিক কী, কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য কমিটির অন্দরে তা-ই নিয়েই উঠছে প্রশ্ন।
|
রেজ্জাক মোল্লা |
সঙ্কট ঘনিয়ে তুলেছেন অবশ্যই আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা। রাজ্য কমিটির সদস্য রেজ্জাকের হজ-যাত্রায় আনুষ্ঠানিক সম্মতি জানিয়েছে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী। মূলত রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুর হস্তক্ষেপে রেজ্জাক আনুষ্ঠানিক অনুমতি পেয়ে গেলেও দলের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে বিস্তর। প্রয়াত সুভাষ চক্রবর্তী তারাপীঠে পুজো দিতে গেলে যদি বিতর্ক হয়, ধর্মাচরণে স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দলের প্রাক্তন সাংসদ কে এস মনোজ যদি ইস্তফা দিতে পারেন, তা হলে রেজ্জাক হজ করতে যাওয়ার অনুমতি পান কী ভাবে বিস্ময় তৈরি হয়েছে দলের একাংশে! রেজ্জাক অবশ্যই এই সব আমল দিতে নারাজ। কিন্তু বিষয়টির মধ্যে যে বিতর্কের গন্ধ আছে, অস্বীকার করতে পারছেন না সিপিএমের শীর্ষ নেতৃত্বের একাংশও।
আলিমুদ্দিনের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল, দলের এমন এক পলিটব্যুরো সদস্যের বক্তব্য, “গঠনতন্ত্রে ধর্মাচরণ নিয়ে কোনও বাধা নেই। হজ-যাত্রীদের সহযোগিতা করার জন্য হজ কমিটিতে এই জন্যই আমাদের দলের সদস্যদের কাজ করতে দেওয়া হয়। কিন্তু যাঁরা দলের পরিচিত মুখ, তাঁদের ধর্মাচরণ না-করাই ভাল।” এই যুক্তিতে রেজ্জাক সিপিএমের অত্যন্ত পরিচিত মুখ। কাজেই তাঁর হজ-যাত্রা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে বাধ্য। ওই পলিটব্যুরো সদস্যের আরও বক্তব্য, “কেউ ব্যক্তিগত ভাবে ধর্মাচরণ করতে চাইলে, তাঁকে হয়তো নিয়ম অনুযায়ী নিরুৎসাহ করা যায় না। কিন্তু তা-ই বলে উৎসাহিতও কোনও ভাবে করা যায় না!” এই যুক্তি সামনে রেখেই আলিমুদ্দিনের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ১২-১৪ অক্টোবর কেন্দ্রীয় কমিটি বা তার পরে রাজ্য কমিটির বৈঠকেও সরব হতে চায় দলের একাংশ।
যে পলিটব্যুরোয় হজ-প্রশ্নে সংশয় রয়েছে, তাদেরই আবার বিজেপি-সঙ্গের অভিযোগ সামাল দিতে হচ্ছে! যে অভিযোগে প্রকাশ্যে সর্বাগ্রে সরব হয়েছেন স্বয়ং রেজ্জাকই। এফডিআইয়ের বিরুদ্ধে খুচরো ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিবাদ-মঞ্চে দিল্লিতে নিতিন গডকড়ী, মুরলী মনোহর জোশীর সঙ্গেই উপস্থিত ছিলেন সিপিএমের পলিটব্যুরোর সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি। যা নিয়ে রেজ্জাকদের প্রশ্ন, বিজেপি একই সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী এবং সাম্প্রদায়িক। তাদের সঙ্গে ‘গলাগলি’ করলে সংখ্যালঘুদের কাছে কী বার্তা যাবে? এই সংখ্যালঘুদের কাছে ঠিক বার্তা পৌঁছে দেওয়ার খাতিরেই কি রেজ্জাকের রাশ টেনে ধরল না আলিমুদ্দিন? প্রশ্ন দলের মধ্যেই। এই অংশের বক্তব্য, মুখ্যমন্ত্রী মমতা ইমামদের ভাতা দিলে গৌতম দেবরা তাঁকে তুলোধোনা করবেন অথচ ‘বস্তুবাদী’ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হয়ে রেজ্জাক হজে যাওয়ার অনুমতি পাবেন কোন বিচারে? রাজ্য কমিটির এক সদস্যের কথায়, “এ বার তো কেউ তারাপীঠে পুজো দেওয়া, গুরুদ্বারে প্রার্থনা বা ভ্যাটিকান সিটিতে যাওয়ার অনুমতি চাইতে পারেন! তখন কী বলে ঠেকানো হবে?” প্রসঙ্গত, রেজ্জাক ছাড়াও সিপিএমের চিকিৎসক-নেতা ফুয়াদ হালিম এ বার হজে যাচ্ছেন। তবে পুণ্যার্থী হিসাবে নয়। হজ কমিটির নির্বাচিত সদস্য হিসাবে সরকারি প্রতিনিধিদলের হয়ে।
কেরলের এ পি আবদুল্লাকুট্টি এবং কে এস মনোজ বিদ্রোহী হয়েছিলেন ধর্মাচরণে স্বাধীনতার প্রশ্নে সিপিএমের উদারতার অভাবের কথা বলে। দু’বছর আগে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির মুখপত্রে তখন কলম ধরে সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, ধর্মবিশ্বাসীরা সিপিএমে আসতে পারবেন না এমন কোনও কথা নেই। কিন্তু তাঁদের দলের কর্মসূচি, গঠনতন্ত্র এবং সাংগঠনিক শৃঙ্খলা মানতে হবে। দলের সর্বশেষ শুদ্ধিকরণ দলিলে সামনের সারির নেতাদের সাড়ম্বর বিবাহ বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন ও ব্যক্তিগত ভাবেও ধর্মীয় আচার পালনে যে বারণ করা হয়েছে, সে কথাও উল্লেখ করেছিলেন কারাট।
কিন্তু এই ব্যাখ্যা মানতে নারাজ রেজ্জাক। তারাপীঠে পুজো দেওয়া নিয়ে বিতর্কের সময় সুভাষবাবু বলেছিলেন, তিনি হিন্দু এবং ব্রাহ্মণ, এই পরিচয় অস্বীকার করতে পারবেন না। রেজ্জাকের সুরও অনেকটা সেই রকম। তাঁর সাফ কথা, “আমার একটা রাজনৈতিক এবং একটা সামাজিক সত্তা আছে। এই সামাজিক সত্তাকে কখনও বিসর্জন দিইনি। আমি তো মুসলিম। নমাজ পড়তে, রোজা করতে পারলে হজে যেতে পারব না কেন?” এই কথাই বিমানবাবুকে বলে এসেছেন রেজ্জাক। কিন্তু তাঁর দল তো নাস্তিক। রেজ্জাকের সপাট জবাব, “দল নাস্তিক বা আস্তিক নয়। কেউ কেউ নিজেকে নাস্তিক দাবি করে। কিন্তু তাদের বাড়িতে বৌয়েরা লক্ষ্মী পুজো করে! এরা সব ভেজাল সিপিএম!” তবে চিরাচরিত পুণ্যার্থীর মতো ‘হজ স্পেশ্যাল’ উড়ানে না-গিয়ে রেজ্জাক দুবাই হয়ে জেড্ডার বিমানে আসন বুক করেছেন। হজ থেকে ফিরে তিনি কি নামের আগে ‘হাজি’ লিখবেন? রেজ্জাক বলছেন, “তা কেন? আমার নিজের নাম আছে! বিলেত থেকে এলেই কি সবাই নামের আগে বিলেত-ফেরত লেখে?”
রাজ্য কমিটির সদস্য, এক প্রাক্তন সাংসদের মতে, “সাম্প্রতিক কালে দেখেছি, জেলা বা জোনাল কমিটির অনেক সদস্য হজ করে এসে দলের কর্মসূচি দিব্যি পালন করছেন! গঠনতন্ত্রে তো কোনও বাধা নেই। ব্যক্তিটি রেজ্জাক বলেই হয়তো বিতর্ক হচ্ছে।” আবার রাজ্য নেতৃত্বের একাংশের পাল্টা ব্যাখ্যা, অনুমতি না-দিলে রেজ্জাক আরও হইচই বাধাতেন। তার চেয়ে অনুমতি দিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া গেল, তিনি যা করছেন করুন। দল তাঁকে নিয়ে ভাবছে না!
আসলে উভয় সঙ্কট! |