মাধ্যমিকের গণ্ডি না টপকেই কলেজ পরিচালন সমিতির মাথায় বসে যাচ্ছেন অনেকে। আক্ষেপ তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায়ের। আর পদার্থবিদ্যার এই প্রাক্তন শিক্ষকের মন্তব্য ফের বুঝিয়ে দিল, শিক্ষাজগতের কাজকর্মে দলতন্ত্রের আধিপত্য নিয়ে বাম আমলে যে ভূরি ভূরি অভিযোগ উঠত, রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের পরেও তার চালচিত্রে কোনও বদল আসেনি। দলের আশীর্বাদী হাত মাথায় নিয়ে এখনও শিক্ষাজগতের নিয়ন্ত্রক বহু অযোগ্যই।
শনিবার আশুতোষ কলেজে নিখিল বঙ্গ অধ্যক্ষ পরিষদের এক সভায় সৌগতবাবু বলেন, “কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতি হওয়া এখন আর মোটেই গর্বের ব্যাপার নয়। শুনেছি, অনেকেই এইট পাশ করে পরিচালন সমিতির সভাপতি হচ্ছেন।”
সৌগতবাবু নিজে কৃতী ছাত্র, কৃতী শিক্ষক। তিনি আশুতোষ কলেজেরই শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে তিনি ওই কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি। তাঁর এ দিনের মন্তব্য শুনে শিক্ষা জগতের অনেকেই মনে করছেন, সৌগতবাবু নিজের দলকেও ক্লিনচিট দিচ্ছেন না। |
সৌগত রায় ও ব্রাত্য বসু: নিজস্ব চিত্র, আরাবুল: এবিপি আনন্দ |
বিশেষত অধ্যক্ষ নিগ্রহের ঘটনার নিন্দা করতে গিয়ে তিনি সরাসরিই বলেছেন, “রামপুরহাট কলেজের অধ্যক্ষকে নিগ্রহ, রায়গঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষের জামা ধরে ছাত্রদের টানাটানির মতো ঘটনা আমাকে লজ্জা দেয়।” এই দু’টি ঘটনাতেই অভিযোগের আঙুল তৃণমূল ছাত্র পরিষদের দিকে।
বাম জমানায় রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রটি কার্যত নিয়ন্ত্রিত হত আলিমুদ্দিনের অঙ্গুলিহেলনেই। রাজনীতির অন্দরমহলে সেই প্রক্রিয়া ‘অনিলায়ন’ নামে পরিচিত ছিল। নতুন সরকারের আমলেও সেই অনিলায়নের উত্তরাধিকার ছেড়ে বেরোনোর চেষ্টা যে দেখা যাচ্ছে না, সে কথাই খোদ সৌগতবাবুর বক্তব্যেও উঠে এল বলে মনে করা হচ্ছে। শিক্ষায় দলীয় নিয়ন্ত্রণের নিগড় আলগা করা হবে না বলেই দলের আস্থাভাজন এইট-পাশ ব্যক্তিরা কলেজ পরিচালন সমিতিতে জায়গা করে নিতে পারছেন, এমনটাই মনে করছেন শিক্ষাবিদেরা।
রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের পরে যে কলেজগুলি তাদের পরিচালন সমিতির সভাপতির কার্যকলাপের জন্য খবরের কাগজের শিরোনাম হয়েছে, তার মধ্যে সবার আগে রয়েছে ভাঙড় কলেজ। যেখানে পরিচালন সমিতির সভাপতি তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলাম। কলেজে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বসার ঘরে ঢুকে জলের জগ ছুড়ে মারার অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের শাসানোর অভিযোগও ছিল। তখনই প্রশ্ন ওঠে, স্কুলের গণ্ডি না-পেরনো অথবা কোনও ক্রমে পেরনো লোকেদের কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতি করা উচিত কি না। এ দিন আশুতোষ কলেজের সভায় খোদ সৌগতবাবুর মন্তব্য সেই প্রশ্নকেই উস্কে দিল। আরাবুলের নাম যদিও সৌগতবাবু নেননি। কিন্তু অনেকেই মনে করছেন, তাঁর ইঙ্গিত আরাবুল এবং রাজনৈতিক কৃপায় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তখতে বসা আরও কিছু নেতার দিকেই।
রাজ্য জুড়ে অনেক কলেজেই অষ্টম শ্রেণি, দশম শ্রেণি, উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ বা অনুত্তীর্ণ, কলেজের গণ্ডি না-পেরনো রাজনৈতিক নেতারা কলেজ শাসন করছেন। পূর্ব বা পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে শুরু করে উত্তরবঙ্গের দিনহাটা, শীতলখুচি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এমন নেতাদের অভাব নেই। আরাবুল নিজে তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতার অভাবের কথা মেনে নিয়েছেন। তবে তাঁর দাবি, তিনি কলেজের উন্নয়নের জন্য মোটা টাকা এনেছেন, গ্রন্থাগারের উন্নতি ঘটিয়েছেন। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও তাঁর কলেজ শাসনের এক্তিয়ার জন্মায় কি না, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। জাতীয় গ্রন্থাগারের অধিকর্তা স্বপন চক্রবর্তী এ প্রসঙ্গে বলেন, “সাধারণ ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার ভার শিক্ষাবিদদের উপরেই থাকা উচিত।” একমত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাসও। তাঁর কথায়, “শিক্ষার সঙ্গে সরাসরি জড়িত মানুষদেরই উচ্চশিক্ষা পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাওয়া উচিত। গোটা বিশ্বে এটাই প্রক্রিয়া।” এ বার দলের মধ্যে থেকেই সৌগতবাবুর মতো বর্র্ষীয়ান নেতা শিক্ষায় অশিক্ষার অনুপ্রবেশ নিয়ে যে ভাবে মুখ খুললেন, তাতে কি পরিস্থিতি বদলাবে? শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে জিজ্ঞাসা করে তেমন কোনও পদক্ষেপের ইঙ্গিত অবশ্য মেলেনি। ব্রাত্য বলেন, “এ ব্যাপারে আমার কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। উনি (সৌগত রায়) ওঁর ব্যক্তিগত মত জানিয়েছেন।”
ক্ষমতায় আসার পরে অবশ্য দলতন্ত্রের হাত থেকে মানুষকে রেহাই দেওয়ারই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শিক্ষাক্ষেত্রে দল বা সরকার মাথা গলাবে না, এমনই প্রত্যাশায় ছিলেন রাজ্যবাসী। কিন্তু কিছু দিন পর থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন কলেজে নৈরাজ্য, অধ্যক্ষ নিগ্রহ, ছাত্র সংসদ নির্বাচন ঘিরে অশান্তি এবং পরিচালন সমিতিতে রাজনৈতিক দাদাদের খবরদারির ঘটনা সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হতে থাকে। দলের অন্দরে মমতা নিজে আরাবুলের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেন। ছাত্রনেতা শঙ্কুদেব পণ্ডাকে সতর্ক করে দেন। কিন্তু তাতে বাস্তব পরিস্থিতির ফারাক হয়নি। আরাবুল বা শঙ্কুদেবকেও তাঁদের পদ ছাড়তে হয়নি।
শিক্ষক মহলের একাংশ বিস্ময় প্রকাশ করে বলছেন, মমতা নিষেধ করলে কি শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়াই তৃণমূলের নেতা-নেত্রীরা বিভিন্ন কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি হতে পারতেন! বা তাঁর দলের ছাত্র সংগঠনের সমর্থকেরাও অধ্যক্ষ নিগ্রহের ঘটনায় জড়িয়ে পড়তেন! ফলে দলীয় দাদাগিরি বন্ধ করতে বলাটা অনেকাংশে কথার কথা হয়ে থেকে গিয়েছে বলেই তাঁরা মনে করছেন। উপরন্তু সম্প্রতি রাজ্য সরকার যে ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের নিয়ম বদল করে নিয়োগ কমিটিতে ইউজিসি-র প্রতিনিধির বদলে সরকার-মনোনীত প্রতিনিধি রাখার কথা বলেছে, তাতেও দলতন্ত্রের হাত মজবুত করারই চেষ্টা ফুটে বেরিয়েছে।
দলীয় সূত্রে এ কথা স্বীকারও করা হচ্ছে যে, শিক্ষার খরচ যেহেতু সরকার বহন করে, তাই শিক্ষক নিয়োগে সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত বলেই মনে করে দল। অর্থাৎ অনিলায়ন থেকে বেরনো নয়, অনিলায়নের প্রয়োজনীয়তাই কার্যত মেনে নিচ্ছে নতুন শাসক দলও। অথচ সৌগতবাবু কিন্তু এ দিন জোর দিয়েছেন রাজধর্মের উপরেই। শিক্ষকদের প্রতি তাঁর স্পষ্ট বার্তা ছিল, “অধ্যক্ষদের নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে আপনারা সরকারকে জানান। এক জন অধ্যক্ষ নিগৃহীত হলে, সবাই মিলে সত্যাগ্রহে বসুন।” |