শতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি...
তাঁর ভূমিকা ছিল কালজয়ী
প্রায় জন্ম থেকেই আমি আনন্দবাজার পত্রিকার সঙ্গে জড়িত। অর্থাৎ, যখন আমার এক-দেড় বছর বয়েস, তখন আমি কথা বলতে শিখিনি, হাঁটতেও পারি না, তবু হামাগুড়ি দিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকা আনন্দবাজার পত্রিকা লণ্ডভণ্ড করেছি। কোনও দিন বা কিছুটা অংশ চিবিয়েও খেয়ে ফেলেছি। তার পর ওই পত্রিকা দেখেই আমার অক্ষরজ্ঞান শুরু হয়। অর্থাৎ, আমার বাবা-কাকারা বরাবরই আনন্দবাজারের পাঠক। অন্য কোনও পত্রিকা রাখা হত কি না তা আমার মনে নেই। তবে আনন্দবাজারটা নিয়মিতই রাখা হত এবং খবরের কাগজ হিসেবে মনে করা হত অবশ্যপাঠ্য।
দু’পায়ে উঠে দাঁড়াবার এবং দৌড়োদৌড়ির ক্ষমতা অর্জন করার পর আমিও শনিবারের শেষ পৃষ্ঠায় ‘আনন্দমেলা’ নামে বিভাগটি (তখনও ওই নামে কোনও পত্রিকা বের হয়নি) থেকেই অনেক ছড়া মুখস্ত করেছিলাম। ওই বিভাগের সম্পাদক ছিলেন কবি বিমলচন্দ্র ঘোষ। ছদ্মনাম ‘মৌমাছি’। আনন্দবাজারের সহযোগিতায় সে সময় ‘মণিমেলা’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এর অনেকগুলি কার্যালয় স্থাপিত হয় কলকাতায়। বৃহত্তর বাংলায়, ভারতেরও কোনও কোনও জায়গায় এর শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এদের বার্ষিক সমাবেশ হত বিশাল আকারে। বিভিন্ন জায়গা থেকে আসত প্রতিনিধির দল। মুখ্যমন্ত্রী বা অতি-বিখ্যাত কেউ কেউ এসে পড়তেন উৎসবে যোগ দিতে। ওই রকম এক বার্ষিক সমাবেশে সুনীল নামে একটি পাঁচ-সাত বছরের শিশুর একটি ছড়া বলার অধিকার পেয়ে কী আনন্দ যে হয়েছিল!
আর একটু বড় হয়ে যখন সামান্য লেখালিখি শুরু করেছি, তখন ওই পৃষ্ঠাতেই নিজের লেখা ছড়া পাঠিয়েছি, তা ছাপাও হয়েছে। ওখানে একটা ছড়া ছাপা হলে পাঁচ টাকার একটা মানি অর্ডার পাওয়া যেত। তখনকার দিনে সেই পাঁচটা টাকা ছিল খুবই দামি। যাতে ঘন-ঘন আমার ছড়া সেখানে ছাপানো হয়, সে জন্য আমি একটি প্রক্রিয়াও আয়ত্ত করেছিলাম। অন্য কোনও বিষয় নিয়ে ছড়া বা কবিতা লিখলে তা অনেক সময় মনোনীত হত না। কিন্তু বিদ্যাসাগর, মাইকেল, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, এঁদের জন্মদিন উপলক্ষে কিছু একটা লিখে পাঠালে নির্ঘাত সেটা ছাপা হত। আমি ঘন-ঘনই পাঁচ টাকা পেতে লাগলাম। মনীষীদের জন্মতারিখ আমি আগে থেকেই খেয়াল করে লিখে রাখতাম।
এই পত্রিকারই মালিকানায় প্রকাশিত হত ‘দেশ’ নামে সাহিত্য-পত্রিকা। ‘দেশ’ আর ‘আমি’ প্রায় সমান বয়েসি। আমি যখন ছড়া-টড়ার বদলে বাংলা কবিতার জগতেও ঢুকতে চাই, তখন ওই ‘দেশ’ পত্রিকাতেই ছাপা হয়েছিল আমার জীবনের প্রথম কবিতা।
অনেকে প্রশ্ন করেন, আমি রবীন্দ্রনাথকে স্বচক্ষে দেখেছি কি না। দেখা হলেও হতে পারত। তাঁর প্রয়াণের সময় আমি সাত বছরের বালক। তাঁকে দেখেছিও বলা যায়, আবার দেখিনি, তাও বলা যায়। আসলে, বাইশে শ্রাবণ সকালে আমাদের স্কুল থেকে অনেক ছাত্রকেই নিয়ে যাওয়া হয় বিবেকানন্দ রোডের একটা বাড়ির ছাদে। তার মধ্যে আমিও ছিলাম। সেই বিমলচন্দ্র ঘোষ, অর্থাৎ ‘মৌমাছি’ আমাদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন। এক সময় দেখলাম এক বিপুল জনস্রোত, তার মাঝখানে একটা খাটের ওপর শয়ান এক জন মানুষকে। তাঁকে এত বেশি ফুলের মেলা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছিল, যে তাঁর মুখখানি ছাড়া আর কিছু দেখার উপায় ছিল না। সত্যি কথা বলতে কী, তখনও রবীন্দ্রনাথের মাহাত্ম্য ঠিক বুঝতাম না। পাঠ্যবইতে তাঁর দু’একটা লেখা মুখস্ত করেছিলাম মাত্র।
আমাদের যৌবনে বাংলা সাহিত্যের অনেকখানি অধিকার রক্ষা করে এসেছিল দু’টি সংবাদপত্র। আনন্দবাজার গোষ্ঠী আর যুগান্তর গোষ্ঠী। আমি প্রথম থেকেই আনন্দবাজারের দলে, ‘যুগান্তর’ গোষ্ঠীর কোনও পত্রিকায় আমার এই দীর্ঘ জীবনে একটাও রচনা প্রকাশিত হয়েছে কি না তা আমার মনে নেই। এই দুই গোষ্ঠীর বাইরে ছিল কয়েকটি ছোট ছোট অসংগঠিত গোষ্ঠী। সেগুলি লিটল ম্যাগাজিনের। আমি লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গেই বেশি জড়িত হয়ে পড়ি এক সময়। নিজেই তখন ‘কৃত্তিবাস’ নামে পত্রিকার সম্পাদক।
সেই কালে আনন্দবাজারের সম্পাদক ছিলেন অশোককুমার সরকার। ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন সাগরময় ঘোষ। সাগরময় ঘোষ বাচ্চা-বাচ্চা কবি-লেখকদের সঙ্গে অনায়াসে বন্ধুত্ব করে নিতে পারতেন, কিন্তু অশোককুমার সরকারের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ হয়নি। তিনি এসে বসতেন ওই অফিসেরই এক বিশেষ কক্ষে, যেখানে আমন্ত্রণ না পেলে কারুরই প্রবেশাধিকার ছিল না।
আনন্দবাজার সংস্থাটি তখন বেশ বড় হয়ে উঠেছে। তার জন্য অশোককুমারেরও কৃতিত্ব ছিল অনেকখানি। অর্থাৎ, তিনি মালিক আর আমরা সবাই কর্মচারী। মালিক ও কর্মচারীদের শান্তিপূর্ণ সুসম্পর্ক বাঙালিদের মধ্যে বেশিদিন দেখা যায় না। কিন্তু আমরা অশোককুমার সম্পর্কে কোনও নিন্দামন্দ বা ক্ষোভের পরিচয় কখনও পাইনি, কারণ তিনি অনেকখানি স্বাধীনতা দিয়েছিলেন আমাদের।
যেমন, এই পত্রিকার সহ-সম্পাদক সন্তোষকুমার ঘোষের ওপরেই ছিল অনেকখানি দায়িত্ব। সন্তোষকুমার ঘোষই এই পত্রিকার নানা বিস্তারের কথা আমাদের জানাতেন। সন্তোষকুমার ছিলেন ছটফটে ধরনের মানুষ। তাঁর মুখের কথায় কোনও আগল ছিল না। কিন্তু তিনি কখনও অশোককুমার সম্পর্কে কোনও উষ্মা প্রকাশ করেননি। এই সন্তোষকুমার ঘোষই বাংলা সংবাদপত্রে চলিত ভাষার প্রয়োগ শুরু করেছিলেন, এ তথ্য কি এখনকার প্রজন্মের সবাই জানে? তাঁর আগে সব রকম গদ্য লেখার ভাষাই ছিল সাধু ভাষা।
আনন্দবাজার গোষ্ঠীর বিরোধীও তো অনেক লোক ছিল। কোনও কোনও গোষ্ঠী সকালে উঠে এক গ্লাস জল খাওয়ার আগেই আনন্দবাজারের মুণ্ডপাত করে নিত। কিন্তু কখনও কোথাও অশোককুমার সরকারের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কাউকে আঘাত বা অভিযোগ করতে দেখিনি।
কালপ্রবাহে অনেক কিছুর মতোই বাংলা সংবাদপত্র জগতেরও নানা পরিবর্তন ঘটেছে। বাংলা গদ্য-ব্যবহার শুরু হয়েছিল টলমলে নৌকোর যাত্রীর মতন। কয়েকজন পাদ্রি ছিলেন সহযোগিতায়। রবীন্দ্রনাথ এসে এই ভাষাকে বিশ্বের অন্যতম প্রধান ভাষায় প্রতিষ্ঠিত করলেন। এখন বাংলা গদ্য যেন চলে যাচ্ছে আকাশ দিয়ে! কী ভাবে এই গদ্যভাষা পাঠকদের কাছে প্রকাশিত হবে, সে সম্পর্কে এখনও আমার ঠিক মতো জ্ঞান হয়নি। তবে এখনকার প্রজন্মের লেখক ও পাঠকেরা নিশ্চিত খুব তাড়াতাড়ি আয়ত্ত করে ফেলছেন। তবু এই ভাষার নির্মাণ ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে কয়েক জন সম্পাদকের কালজয়ী ভূমিকা আছে, তাঁদের মধ্যে অশোককুমার সরকার নিশ্চয়ই অগ্রগণ্য।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.