শতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি...
অনেক দিক থেকেই তিনি ছিলেন পথিকৃৎ
বোধ হয় জাতীয় জীবনে প্রতি বৃহৎ সংবাদপত্র-গোষ্ঠীর ইতিহাস দ্বারা নির্ধারিত একটি জায়গা থাকে। “ব্রিটেনে যে জায়গা ‘দ্য টাইমস্ সংবাদপত্রের, সেই জায়গায় ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ বঙ্গদেশে রয়েছে।” এবং এই জায়গায় এই পত্রিকাকে নিয়ে এসেছিলেন অশোক সরকার। ১১ মার্চ ১৯৮৩ সালে লন্ডনের ‘দ্য টাইমস্’ সংবাদপত্রে, ১৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে অশোককুমার সরকারের মৃত্যুর পর, এই মত প্রকাশ পায়। তাঁর সম্বন্ধে তখন নানা পত্রপত্রিকায় অনুরূপ প্রশংসাবাণী দেখা যায়। এটা স্বাভাবিক যে দেশের সংবাদমাধ্যমগুলি বৃহৎ পত্রিকা ও প্রকাশনা সংস্থানের কর্ণধারকে নানা প্রশংসায় ভূষিত করবে। কারণ অনুমেয়। কিন্তু স্বার্থ-গোষ্ঠীর ও প্রতাপের ছায়ার বাইরে, নিরপেক্ষতার আলোয় বিদেশি চোখে উল্লিখিত মূল্যায়ন ঘটেছিল প্রয়াত সম্পাদকের। আজ অশোককুমার সরকারের জন্মের একশত বৎসর পরে, তাঁর শংসাপত্র লেখার কোনও প্রয়োজন নেই। দরকার হল সেই সময়ে তাঁর কী ভূমিকা ছিল সেটা বোঝবার চেষ্টা।
১৯২০-র দশক থেকে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ জাতীয়তাবাদী, বিশেষ ভাবে গাঁধীবাদী আদর্শের জন্য পরিচিত ছিল। প্রফুল্লকুমার সরকার, সুরেশচন্দ্র মজুমদার ও দু’এক জন বিখ্যাত সহযোগী যে সম্পাদকীয় নীতি নির্ধারণ করেছিলেন তার ফল ছিল পত্রিকার আর্থিক অনটন এবং রাজদ্রোহের অভিযোগে বারবার অর্থদণ্ড এবং আদালতে বা কারাগারে দুর্ভোগ। স্বাধীনতার পরবর্তী দশক ছিল পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে নানা দুর্যোগের সময়, যদিও মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় সদা সচেষ্ট। পূর্ব পাকিস্তান থেকে শরণার্থীর ভিড়, কলকাতায় বঞ্চিত দুঃস্থ মানুষের বস্তির প্রসার। একই দশকে মাথাপিছু আয় দেখা যায় সব ভারতীয় রাজ্যে বৃদ্ধি পায়, ব্যতিক্রম পশ্চিমবঙ্গ ও অসম। মাসুল সমীকরণ নীতি গ্রহণ করে ভারত সরকার রেলপথে লৌহ-ইস্পাতের পরিবহণ খরচ ভারতে সর্বত্র এক করে দেওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের ক্ষতি, লাইসেন্স দেওয়ার দুর্নীতিতে পশ্চিমবঙ্গ অনুরূপ ক্ষতিগ্রস্ত, বিপুল পরিমাণ বেসরকারি পুঁজির প্রস্থান অন্য রাজ্যের অভিমুখে শুরু হল। ইত্যাকার নানা সংখ্যা বোধ হয় নিষ্প্রয়োজন, অবস্থা ছিল স্বতঃপ্রতীয়মান। সরকারের সমর্থন অন্য কোথাও থাকলেও কলকাতার পত্রপত্রিকার পক্ষে দুর্লভ, অন্য শহরে সমৃদ্ধির নূতন হাওয়া পালে লাগিয়ে কিছু সংবাদপত্র উন্নতি করলেও কলকাতার হাওয়া বিপরীত দিকে। সুতরাং তখন প্রয়োজন ছিল মুদ্রণ ব্যবস্থা এবং ব্যবসায়িক সংগঠন এবং সংবাদ পরিবেশন শৈলীর নবীকরণ দ্বারা প্রতিযোগিতার বাজারে বঙ্গীয় সংবাদপত্রকে প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে দেওয়া।
১৯৫৯ সালে অশোককুমার সরকার যখন সম্পাদক হলেন তখন তাঁর প্রস্তুতিপর্ব শেষ হয়েছে, বেশ কিছু দিনের জন্য শিক্ষানবিশ হয়ে সংবাদ পরিবেশন ব্যবসা রপ্ত করেছেন। কেবল পারিবারিক মালিকানার জোরে সম্পাদনা সম্ভব, কিন্তু স্কটিশ চার্চ কলেজের এই স্নাতক শিক্ষানবিশি করেন অনেক দিন। কাগজের পরিচালনায়, বিশেষ করে ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনায় ১৯৫৭ থেকে, আনন্দবাজার ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর এক জন ডিরেক্টর হিসেবে, এবং তার পর পরিণত বয়সে তিনি হলেন পত্রিকার সম্পাদক। সিঁড়ি টপকে তিনি সেখানে ওঠেননি।
৭ অক্টোবর, ১৯১২ — ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৩
‘অফ্-সেট’ প্রক্রিয়ার তকনিকি কৌশল আমেরিকার সংবাদপত্রগুলি আয়ত্ত করে ১৯৫০-এর দশকে। তার কয়েক বৎসর পরেই ভারতে যাঁরা এই মুদ্রণ পদ্ধতি প্রয়োগ করেন, অশোককুমার সরকার মধ্যে অন্যতম। বহু দিন আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিযোগী বাঙালি কাগজগুলি ‘হট-মেটাল’ যুগেই পড়ে ছিল, তকনিকি প্রগতির ফলে শোভন ও দ্রুত মুদ্রণ ওই পত্রিকার বিশেষত্ব ছিল। অনেক সংবাদপত্রের মালিক পুরনো টাইপ ফাউনড্রি এবং রোটারি প্রেস ছাড়তে নারাজ ছিলেন। কেননা সেই পুঁজি, যাতে এক সময়ে তাঁরা বিনিয়োগ করেছিলেন, মালিকেরা ফেলে দিতে বা সস্তায় বিক্রয় করে দিতে অনিচ্ছুক ছিলেন। প্রথম দিকে অফ্-সেট প্রক্রিয়া লিথোগ্রাফি জাতীয় হলেও শীঘ্রই একটা সিলিন্ডারের ওপর অ্যালুমিনিয়াম পাতের এবং রবারের পাতার ওপর লেখন তুলে নেওয়া সম্ভব হয় বলে ছাপানোর সময় অনেক কমানো সম্ভব হয়। অর্থাৎ আরও টাটকা, শেষতম মুহূর্তের খবর দেওয়া সম্ভব হয়। কিন্তু গোড়ার দিকে অফ্-সেট প্রিন্টার বিদেশ থেকে আমদানি করতে হত। ফলে ১৯৭৪ সালে জানা যায় যে মাত্র ছয়টি অফ্-সেট ছাপাখানা ছিল সারা ভারতে; ১৯৮৫ সালে, অর্থাৎ অশোককুমার সরকারের মৃত্যুর দু’বৎসর পরে এই সংখ্যা বেড়ে প্রায় এক-হাজারে পৌঁছেছিল। এই বৈপ্লবিক পরিবর্তনে অশোককুমার সরকার এক জন অগ্রণী উদ্যোক্তা। মুদ্রণের ব্যাপারে তাঁর যে উৎসাহ ছিল তার আর একটি উদাহরণ দেখা যায় ১৯৭৮ সালে। তিনি নিজের উদ্যোগে একটি যন্ত্রপাতি ও ছাপা বইয়ের প্রদর্শনী তৈরি করেন গত দুই শতকে বঙ্গদেশে মুদ্রণ শিল্পের বিকাশ বিষয়ে। উপলক্ষ ছিল ১৭৭৮ সালে নাথানিয়েল হলহেড প্রণীত বাংলা ব্যাকরণের দ্বিশত বৎসর পূর্তি।
তকনিকি উন্নতির জন্য প্রয়োজন পুঁজি বিনিয়োগ, এবং যদি বাইরের থেকে তা না পাওয়া যায়, তবে দরকার আয় বাড়ানো, যাতে বিনিয়োগ সম্ভব হয়। এই উদ্দেশ্যে পত্রিকার বাণিজ্যিক দিকটায় দৃষ্টি দেওয়া দরকার। দরকার পত্রিকার পাতায় বিজ্ঞাপন থেকে আয় বাড়ানোর চেষ্টা। এই ধারায় চেষ্টা নূতন নয়, সব সংবাদপত্রই এই চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু আনন্দবাজার পত্রিকার ব্যবসায় নূতনত্ব হল পেশাদার ম্যানেজার নিয়োগ নীতি। বিজ্ঞাপনের অংশ নিয়ে ইংরেজি খবরের কাগজের সঙ্গে প্রতিযোগিতার শুরু সেই আমলে। অন্য ভারতীয় ভাষাতেও একই ধারা। আনন্দবাজারের পক্ষে বিজ্ঞাপনের সিংহভাগ পাওয়া সহজ ছিল, ১৯৮০ সালের হিসেবে দেখা যায় যে ভারতে সিঙ্গল এডিশন কাগজের মধ্যে আনন্দবাজার-এর সার্কুলেশন সর্বাধিক।
ম্যানেজমেন্ট-এর দিকে জোর দেওয়ার আর এক দিক ছিল ভবিষ্যতে সম্পাদক যাঁরা হবেন তাঁদের প্রশিক্ষণ। অশোককুমার সরকার সম্পাদনায় তাঁর উত্তরাধিকারীকে ‘সানডে টাইমস্’-এর সম্পাদক হ্যরন্ড ইভান্স-এর নিকট শিক্ষানবিশ করেছিলেন। অদূর ভবিষ্যতে অন্যান্য সংবাদপত্র গোষ্ঠী একই নীতি অনুসরণ করে। যথা ‘মালয়ালা মনোরমা’র মালিক কোন্ডাথিল পরিবার, বা তেলুগু ‘ঈনাডু’ কাগজের মালিক রামোজি রাও, বা যে যৌথ পরিবার ছিল ‘হিন্দু’ কাগজের মালিক। এই ভাবে আধুনিকতা ও প্রায়োগিক শিক্ষা প্রবেশ করে সংবাদপত্র মহলে। আনন্দবাজার পত্রিকার যেমন সংবাদ পরিবেশন শৈলী ও সম্পাদকীয় পাতার আলোচনা বদলায় তেমনই ঘটতে থাকে ক্রমে অন্যান্য অনেক ভারতীয় সংবাদপত্রে। এর সঙ্গে সহযোগ ঘটে বাণিজ্যিক দিকে আধুনিক ম্যানেজমেন্ট-এর প্রয়োগের। দুই ধারা যুক্ত হয়ে সংবাদপত্র জগৎকে বদলে দিতে শুরু করে।
এ দিকে এই সময়টিতে সংবাদপত্রের বাজার খুব বেড়ে ওঠে। ভারতের রেজিস্ট্রার অব নিউজপেপারস্-এর প্রতিবেদনে জানা যায় যে ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৫, এই কুড়ি বছরে রেজিস্ট্রিকৃত খবরের কাগজের সংখ্যা ৬০২ থেকে ১০৫৬ সংখ্যায় পৌঁছায়। এর ফল বাজারে নূতন সুযোগ, অপর পক্ষে প্রতিযোগিতা। এই অবস্থার প্রতিফলন দেখা যায় সংবাদপত্র জগতের আধুনিকীকরণের প্রবণতায়, যাতে অশোককুমার সরকার এক জন পথিকৃৎ। আধুনিকীকরণের সঙ্গে অনেক দেশে সংবাদপত্রগুলি ব্যক্তিগত মালিকানা থেকে কর্পোরেট ব্যবসা হিসাবে শেয়ার মার্কেটে অধিক পুঁজি সংগ্রহ করে। কিন্তু ভারতীয় ভাষার সংবাদপত্রগুলিতে এই বিবর্তন বিশেষ দেখা যায় না। যত দূর জানি ১৯৯৮ সালের আগে ভারতের কোনও স্টক এক্সচেঞ্জ তালিকায় কোনও ভারতীয় সংবাদপত্র ছিল না। সম্ভবত তখনকার ব্যবসায়িক পরিবেশে যা ছিল তাতে অশোককুমার সরকার বা তাঁর সমসাময়িক সংবাদপত্রের কর্ণধাররা মালিকানার কাঠামো পালটানোর চেষ্টা করেননি, কিন্তু বাণিজ্যিক নীতিতে পরিবর্তন এনেছিলেন।
এই পরিবর্তনের ফলে অর্থাগম, এবং ১৯৫৯ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত অশোককুমার সরকারের সম্পাদনাকালে আনন্দবাজার যেমন সার্কুলেশন বাড়ায়, তেমনই প্রসার ঘটে অন্য নানা ক্ষেত্রে, আনন্দ পুরস্কার কিংবা নন্দাঘুন্টি পর্বত অভিযান কিংবা ইংরেজি ও হিন্দি ভাষায় পত্র-প্রকাশ ইত্যাদি নানা বিচিত্র কর্মধারায়, যেগুলি আনন্দবাজারের শ্রীবৃদ্ধির ফলেই সম্ভব হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে এটাও মনে হয় যে, বাণিজ্যিক সাফল্যের সঙ্গে যে কোনও সংবাদপত্রের স্বাবলম্বন জড়িত। সম্ভবত এই স্বাবলম্বনের ফলেই অশোককুমার সরকার স্বাধীন ভাবে মতামত প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি। অনেক সময়ে প্রতিষ্ঠিত শাসক দলের সমালোচনা করেছেন, সরকারি প্রভাব প্রতিবন্ধক হয়নি। বাণিজ্যিক সাফল্যকে তুচ্ছ জ্ঞান করার অভ্যাস বা ভান সংবাদপত্র গোষ্ঠীর পক্ষে অসম্ভব, যদি না অন্য কোনও আর্থিক অবলম্বন থাকে বা কোনও বিশেষ রাজনৈতিক জনসমর্থন থাকে। এই সব কারণে অশোককুমার সরকারের সময়ে পত্রিকার ব্যবসায়িক দিকটা গুরুত্বপূর্ণ।
তবে এটাও সত্য যে অনেকেই অশোককুমার সরকারকে টেকনোলজি, ম্যানেজমেন্ট, ব্যবসা প্রসারের জন্য স্মরণ করেন না। সাধারণত পাঠকের বোধ হয় মনে থাকে, বাংলার ও বাঙালির জন্য তাঁর সংবাদপত্র কী ভূমিকায় ছিল। ঘটনাচক্রে তিনি সম্পাদনার কাজ হাতে নেওয়ার পরেই ১৯৬০ সালে কয়েকটি ব্যাপারে বাংলার স্বার্থ বিপন্ন হয়: অসম রাজ্যে বাঙালি বিরোধী প্রচার ও আন্দোলন, পূর্ববঙ্গে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি, দণ্ডকারণ্যে বাঙালি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসিত করার ব্যাপারে অবহেলা ও অব্যবস্থা এবং নেহরু নুন চুক্তি অনুসারে বাংলার ছিটমহল, বেরুবাড়ি ইত্যাদি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত। আনন্দবাজার সেই সময় থেকে বাংলার স্বার্থের প্রবক্তা হয়ে ওঠে। তা ছাড়া সাধারণ ভাবে তাঁর সম্পাদনা-কালের আগে ও পরে বাংলার স্বার্থে কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা ছিল পত্রিকার একটা মূল সুর। ভবিষ্যতে এই বিষয়টি দলনির্বিশেষে বাঙালি নেতৃবৃন্দের এজেন্ডার অন্তর্গত হয়। ১৯৬০ সাল থেকে আনন্দবাজার পত্রিকা পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থে যে ভূমিকা নেয় তার প্রসারণ ঘটে বাংলা-ভাষীর স্বার্থে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে। হয়তো জনমানসে অশোককুমার সরকারের সর্বগ্রাহ্য পরিচয় এই যে তিনি বাঙালিকে তার বহুধা কর্মপন্থার কেন্দ্রস্থলে রেখেছিলেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.