অশোককুমার সরকার (১৯১২-১৯৮৩) বয়সে আনন্দবাজার পত্রিকা অপেক্ষা দশ বছরের বড় ছিলেন। বাঙালি সমাজে অনুজের চরিত্র গঠনে এবং জীবনপথের নির্দেশনায় অগ্রজের ভূমিকা স্বীকৃত। কালবৈগুণ্যেও সেই ভূমিকা সম্পূর্ণ অন্তর্হিত হয় নাই। আনন্দবাজার পত্রিকার চরিত্র এবং পথ নির্ধারণে অশোককুমার সরকারের ভূমিকা, আক্ষরিক অর্থেই, ঐতিহাসিক। এক কথায় বলিলে, তিনি ছিলেন বৃহৎ বাঙালি। শব্দবন্ধটি বহুব্যবহারে কিঞ্চিৎ জীর্ণ হইয়াছে, সেই কারণে তাহার মর্মার্থ স্পষ্ট করিয়া বলা জরুরি। প্রকৃত বৃহত্ত্বের পরিচয় নিহিত থাকে মানসিকতায়, দৃষ্টিভঙ্গিতে। অশোককুমার মানসিকতায় বৃহৎ ছিলেন। কোনও এক উপলক্ষে তিনি মন্তব্য করিয়াছিলেন, ইংরাজি ভাষায় যাহা কিছু করা সম্ভব, বাংলা ভাষাতেও তাহা করা সম্ভব। তাঁহার একটি উক্তি এই বৈশিষ্ট্যের অনন্য অভিজ্ঞান। আপাতদৃষ্টিতে কথাটি কেবল ভাষা সম্পর্কিত, কিন্তু তাহার গভীর নিহিতার্থটি ইহাই যে বাঙালিকে উৎকর্ষের সাধনা করিতে হইবে এবং সেই উৎকর্ষের মাপকাঠি হইবে বিশ্বমানের।
১৯৫৯ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণের পরে, বস্তুত তাহার আগে হইতেই, তিনি তাঁহার আদর্শকে এই পত্রিকার চালিকা শক্তি রূপে নির্ধারণ করিয়াছিলেন। এই আদর্শ সহসা আবির্ভূত হয় নাই, এই সংবাদপত্র তাহার জন্মলগ্ন হইতেই চিন্তায় স্বাধীন ও স্বতন্ত্র। অশোককুমার সরকার তাহার এই স্ব-ভাব হইতেই আপন আদর্শের সমিধ সংগ্রহ করেন। ‘বিশ্বায়ন’ শব্দটি আবিষ্কারের বহু পূর্বেই তিনি চিন্তা ও কর্মের বিশ্বায়ন চাহিয়াছিলেন এবং তাহার অভিমুখে বলিষ্ঠ পদক্ষেপে অগ্রবর্তী হইয়াছিলেন। আমরা আজও, তাঁহার জন্মের শতবর্ষ পরে এবং এই পত্রিকার নব্বই বছর পূর্ণ হইবার পরেও, সেই মূল আদর্শকে আমাদের পথনির্দেশিকা বলিয়া গণ্য করি। যে কোনও বিষয়ে, যে কোনও ক্ষেত্রে বিশ্বমানের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছনোই আমাদের লক্ষ্য। তাঁহার দৃষ্টান্ত এবং তাঁহার আশীর্বাদ আমাদের যে ভাবে চালনা করিয়া আসিতেছে, ভবিষ্যতেও সেই ভাবেই চালনা করিবে, এই বিশেষ দিনটিতে তাহাই প্রার্থনা করি।
চিন্তা ও কর্মের বিশ্বায়নের পথে এই অভিযাত্রা সহজ ছিল না। দেশভাগলাঞ্ছিত স্বাধীনতার অভিঘাত বাঙালির মানসলোকের পক্ষে শুভ হয় নাই। ষাটের দশক হইতে সেই মানসলোকের অবক্ষয় প্রকট হইয়া উঠিতে থাকে। চর্তুদিক হইতে নানা ভাবে পর্যুদস্ত পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি ক্রমশ আহত অভিমানে আপন অন্দরে নিজেকে সীমিত ও খর্বিত করিয়া রাখে। উনিশ শতক হইতে যে উদার সর্বগ্রাসী বিশ্বজনীনতা তাহাকে শক্তি দিয়াছিল, রবীন্দ্রনাথ তাঁহার বহু দ্বন্দ্ব এবং অসম্পূর্ণতা লইয়াও আমৃত্যু যে বিশ্বজনীন উদারতার সাধনা করিয়া গিয়াছেন, বাঙালি সেই বৃহতের সন্ধান হইতে নিজেকে নিবৃত্ত করিয়া নিরেট অহঙ্কারে ঘোষণা করিল, ‘আমি সর্বশক্তিমান, কারণ আমিই সত্য’। বঙ্গীয় বামপন্থীদের যে ধারাটি আন্তর্জাতিক উদারতাকে বর্জন করিয়া প্রযুক্তিবিমুখ, পরিবর্তনবিমুখ, ইংরাজিবিমুখ গ্রাম্যতার নেতিবাচক আরাধনায় মন দিলেন, তাঁহারাই রাজনীতির লড়াইয়ে জয়ী হইলেন এবং রাজ্য ও তাহার সমাজকে অচলায়তনে নিক্ষেপ করিলেন।
এই ক্ষুদ্রতার পরিমণ্ডলে অশোককুমার আপন দৃষ্টি ও লক্ষ্যকে খর্ব হইতে দেন নাই। তিনি ছিলেন আদ্যোপান্ত বাঙালি, কিন্তু ক্ষুদ্র বাঙালি নয়, বৃহৎ বাঙালি, বিশ্বজনীন বাঙালি। তাঁহার বাঙালি বনেদিয়ানা কোনও সঙ্কীর্ণতাকে সহ্য করে নাই। সাংবাদিকতার ধারণা, মানসিকতা, ভাষা, প্রযুক্তি প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে তাঁহার চারি পাশের সমাজে যে সঙ্কীর্ণতার বিপুল প্রভাব ছিল, তাহা হইতে নিজেকে মুক্ত রাখিয়া তিনি আপন উচ্চ লক্ষ্য পূরণে অগ্রসর হইয়াছিলেন। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে পৃথিবীর যেখানে যাঁহারা শ্রেষ্ঠত্বের সন্ধানে নিষ্ঠাবান, তিনি তাঁহাদের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করিয়াছিলেন, তাঁহাদের সহযোগিতা লইয়াছিলেন, তাঁহারা বাঙালি না অবাঙালি, স্বদেশি না বিদেশি, সেই ক্ষুদ্র বিচারে তিলমাত্র সময় নষ্ট করেন নাই। বৃহৎ মানুষদের ইহাই ধর্ম। তাঁহারা স্বাধীন স্বতন্ত্র চিন্তার স্ব-ভাব হইতে আপন শক্তি সংগ্রহ করিয়া উৎকর্ষের সাধনায় অবিচল থাকেন। তাঁহারা অন্য কাহারও সহিত প্রতিযোগিতা করিতে ব্যস্ত হন না, তাঁহাদের প্রতিযোগিতা আপনার সহিত। সেই কারণেই, পরিপার্শ্বের ক্ষুদ্রতা তাঁহাদের দৃষ্টিকে আবিল করিতে পারে না, তাঁহাদের স্বপথ হইতে বিচ্যুত করিতে পারে না। এই কারণেই তাঁহার জন্মশতবর্ষের মুহূর্তটি কেবল স্মরণের মুহূর্ত নয়, তাঁহার জীবন ও কর্মের দৃষ্টান্ত এখনও বিশেষ ভাবে প্রাসঙ্গিক। পশ্চিমবঙ্গের সমাজে ক্ষুদ্রতা এখনও সর্বগ্রাসী। এই সমাজে বৃহতের সাধনা সহজ নহে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ভাষা ব্যবহার করিয়া আমরা বলিতে পারি, অশোককুমার সরকারের ‘ভাবয়িত্রী ও কারয়িত্রী’ প্রতিভার দৃষ্টান্ত এই সময়েও বিশেষ ভাবে মূল্যবান। কেবল আনন্দবাজার পত্রিকার পক্ষে নয়, বাঙালির পক্ষে। |