কোন গোষ্ঠীতে না থেকেই তিনি স্বনির্ভর হয়েছেন। সেই সঙ্গে স্বনির্ভর হতে সাহায্য করেছেন সীমান্তের আরও অনেক মহিলাকেই। করিমপুরের লক্ষ্মীপাড়ার স্নিগ্ধা দাস মণ্ডলের পরিচয় চকিতে এটাই—তিনি স্বপ্ন বোনেন।
কিন্তু বছর পঞ্চাশের স্নিগ্ধাদেবীকে এলাকার মানুষ চেনেন লাকি নামে। ডাক নামটাই প্রতিষ্ঠা পেয়ে গিয়েছে। তা হলে কি সবটাই ভাগ্য? কথা কেড়ে নিয়ে লাকি বলেন, “আমি পরিশ্রমে বিশ্বাস করি। নিষ্ঠার সঙ্গে ওটা করে গেলেই ভাগ্য এমনিতেই তৈরি হয়ে যাবে। মা বাবা আদর করে লাকি নামটা রেখেছিলেন ঠিকই। তবে এত বছরের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর দিনের শেষে স্নিগ্ধা নয়, লাকি নামটা শুনতেই বেশি ভাল লাগে।”
তবে লাকির নিজেকে প্রমাণ করার পথটা কিন্তু মসৃণ ছিল না। একটার পর হার্ডল ডিঙিয়েছেন। সতেরো বছর আগে কলকাতার একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মেশিনে উল বোনার প্রশিক্ষণ নেন। তারপর বাড়ি ফিরে খুব কষ্ট করে কেনা একটি মাত্র মেশিন আর কয়েক কেজি উলকে সম্বল করে পথচলা শুরু করেন। জুটে যায় জনা কয়েক ছাত্রীও। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। স্বপ্নপূরণ হয়েছে লাকির। সেই সঙ্গে নদিয়া মুর্শিদাবাদের সীমান্তছোঁয়া গ্রামের অন্তত শ’পাঁচেক মহিলা তাঁর কাছে মেশিনে উল বোনার প্রশিক্ষণ নিয়ে আজ স্বনির্ভর। তাঁদের কেউ কেউ আবার সংসারের জোয়াল তুলে নিয়েছেন নিজেদের কাঁধেই। |
লাকির একেবারে প্রথম দিকের ছাত্রী করিমপুরের জ্যোৎস্না দে বিশ্বাস, ঝুমা সরকার, লিপিকা সরকার, বিউটি বিশ্বাস, আল্পনা মণ্ডলরা। তাঁদের কথায়, “আমরা সবাই লাকিদির কাছে কৃতজ্ঞ। উল বোনার কাজ শিখে আজ আমরা সবাই স্বনির্ভর হয়েছি। আমরাও বাড়িতে মেশিন নিয়েছি, আমরাও এখন অনেককে শেখাই। পাশাপাশি সারা বছর উলের নানা জিনিসপত্র তৈরি করে পাইকারি বাজারে বিক্রি করে দিই। তাতে ভালই লাভ থাকে। নতুন ডিজাইন আমরা নিজেরাই তৈরি করি। এখনও পর্যন্ত কোনও প্রয়োজন হলে আমরা লাকিদির কাছেই ছুটে আসি।” তাঁরা জানান, শীতের মরসুমে সব থেকে বেশি আয় হয়। সকলেই স্বামী, সংসার সামলে স্বনির্ভর হয়েছেন।
লাকি বলেন, “শুধু উলের কাজ শেখানো নয়, সেই সঙ্গে মেয়েদের আরও একটা কথা বলতাম যে, সংসারে আত্মসম্মান নিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে গেলে স্বনির্ভর হতে হবে। কিছু একটা করে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। আজ এত বছর পর ভাবতে ভাল লাগে, শুধু আমি একা নই, আমার মতোই স্বনির্ভর হয়ে স্বপ্নপূরণ করেছে অনেক সাধারণ মেয়েই।”
প্রায় ৩২ বছর আগে একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী লাকি ভালবেসে বিয়ে করেছিলেন করিমপুরেরই এক স্কুল শিক্ষককে। সদ্য পাতা সংসারে হাজার ঝক্কি, সন্তান সামলে উচ্চ মাধ্যমিক তারপর কলেজ। তত দিনে মনে মনে অবশ্য তিনি আর এক পরীক্ষার জন্য নিজেকে তৈরি করে ফেলেছেন। লাকি বলেন, “বাবার একটা গরু নিয়ে চলে এসেছিলাম। সেই গরুর দুধ বিক্রি করে পাঁচ হাজার টাকা জমিয়ে জেদ করে কলকাতার এক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হয়ে কাজটা শিখে এসেছিলাম।” স্বামীর কাছ থেকে কোনও পয়সা নেননি। স্কুলশিক্ষক স্বামী মনোতোষবাবুও কোনও রাখঢাক না রেখেই বলেন, “সংসার, ছেলেমেয়ে, নিজের সেলাইয়ের পাশাপাশি সারা দিন ধরে সেলাই শেখানো, রান্নাবান্না, বাড়ির যাবতীয় কাজকর্ম- একা হাতে ওই তো সব সামলায়। আবার রেগে গেলে মাঝেমধ্যে বলে- ‘আমার কি দশটা হাত আছে নাকি?’ ও যা করেছে সেটা সত্যিই কুর্নিশ করার মতো।” |