|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
তারায় গেঁথে দেওয়া কাহিনি |
যুধাজিৎ দাশগুপ্ত |
তারায় তারায়, শিশিরকুমার দাশ। কারিগর, ২২০.০০ |
ঐতরেয় ব্রাহ্মণে একটা অদ্ভুত কাহিনি আছে: প্রজাপতি একবার তাঁর কন্যার প্রতি আসক্ত হন। ভীতা কন্যা উপায়ান্তর না দেখে এক হরিণীর রূপ নেয়, কিন্তু প্রজাপতিকে ফাঁকি দিতে পারে না। তিনিও এক হরিণের রূপ নেন। তখন বিচলিত ও উদ্বিগ্ন দেবতারা নিজেদের অংশএকত্র করে ভূতবান নামে এক পুরুষ সৃষ্টি করেন। ভূতবান দেবতাদের আদেশে তিরবিদ্ধ করে প্রজাপতিকে, অনাসৃষ্টি বন্ধ হয়। ভূতবানের প্রার্থনা অনুযায়ী দেবতারা তাকে নক্ষত্র করে দেন। তার নাম হয় মৃগব্যাধ।
এমন অজাচার-মূলক কাহিনি কেন উপনিষদে স্থান পেল তা এক বিস্ময়, আরও বিস্ময়কর সম্ভবত এ কাহিনিটিকে আকাশের তারায় গেঁথে দেওয়া। মৃগব্যাধ হল আজকের ‘ক্যানিস মেজর’ তারামণ্ডলী (‘বড় কুকুর’, রাতের আকাশের উজ্জ্বলতম তারা লুব্ধক যার অন্তর্গত। প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিদ্যায় গোটা তারামণ্ডলীটিরই নাম ছিল লুব্ধক)। মৃগরূপী প্রজাপতি আজ আকাশে ওরিয়ন বা কালপুরুষ নামে পরিচিত। ওরিয়নের কোমরবন্ধনীর তিনটি তারা সেই মতে প্রজাপতিকে বিদ্ধ করে থাকা তির। বৃষ রাশির রোহিণী (আলডেবারান) ও কাছাকাছি অন্যান্য তারা হল সেই মৃগরূপী কন্যা। মৃগব্যাধ (লুব্ধক), প্রজাপতি (কালপুরুষ) আর রোহিণী আকাশে রয়েছে পাশাপাশি, প্রায় একরেখায়। হেমন্তরাতে, শীতের সন্ধ্যায় এরা আকাশে অন্যতম দ্রষ্টব্য।
আকাশের তারা ও অন্যান্য জ্যোতিষ্ক কী করে নানা রূপে পৃথিবীর সমস্ত জাতির পুরাণকথায় ঢুকে পড়ল মানুষ পুরাণের কাহিনিকে সে সবের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলল, নাকি আকাশের ঘটনাক্রমকেই রূপ দিল পুরাণকথায়, সে তর্ক সজীব গবেষণার ক্ষেত্র। মিথ অর্থে পুরাণও কোনও সরল নির্মাণ নয়। শিশিরকুমার দাশ (১৯৩৬-২০০৩) অবশ্য এ সব তর্কে ঢুকতে চাননি। তিনি তারায় তারায় (প্রথম প্রকাশ ১৯৬০। গ্রন্থনাম নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর দেওয়া) লিখতে শুরু করে ন কাহিনির টানে এবং মূলত অল্পবয়সিদের জন্য। বিভিন্ন কিশোরপাঠ্য পত্রপত্রিকায় রচনাগুলি বেরিয়েছিল পঞ্চাশের দশকে। প্রাচীন গ্রিক ও ভারতীয় সাহিত্য মন্থন করে তাঁর নানা আহরণ ও গভীর প্রশ্নাবলি আমরা আরও পেয়েছি অলৌকিক সংলাপ-এ। অসামান্য স্বাদু গদ্য এ বইটিকে একবারে পড়ে শেষ করে ফেলতে বাধ্য করে। পঁচিশটি রচনায় গ্রহ, তারা, চাঁদ, সূর্য নিয়ে তিনি সাজিয়েছেন নানা কাহিনি-উপকাহিনি। নজরে না পড়ে পারে না, বেশিরভাগ কাহিনিরই বিষয় ঈর্ষা, ষড়যন্ত্র, হত্যা। এবং অবশ্যই প্রেম; বিচ্ছেদ যাকে উজ্জ্বলতর করে। চিন, জাপান, মিশর, গ্রিস, রোম, আরব ইত্যাদি দেশের কাহিনি এখানে যত জায়গা পেয়েছে, ভারতের কাহিনি ততটা নয়। হয়তো তাঁর উৎসগ্রন্থটি একজন পশ্চিমি মানুষের লেখা বলে। তাঁরা গ্রিসীয় কাহিনি পুনরাবিষ্কার করেছিলেন আরবদের ঘরে (যে-কারণে অধিকাংশ তারার প্রচলিত ইংরেজি নাম আরবি শব্দ থেকে)। ওপরের কাহিনিটি অবশ্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর মূলানুগ অনুবাদ অনুসরণ করে শিশিরকুমার সংযোজন করেছেন, যার শুরু: ‘পুরাকালে প্রজাপতি আপন কন্যার উদ্দেশে ধ্যান করিয়াছিলেন।’
শিশিরকুমার নিজে রাতের আকাশ পর্যবেক্ষণ করতেন কি না জানি না, এ বই পাঠককে আকাশ দেখতে উদ্বুদ্ধ করবে এমন কোনও ভাবনাও বোধহয় তাঁর ছিল না। কিন্তু বইটিতে তার সম্ভাবনা রয়ে গিয়েছে। আরও সম্ভাবনা রয়েছে এই কাহিনিগুলির তলায় তলায় বয়ে যাওয়া সেই সব ইতিহাস, ধর্মবিশ্বাস, লোকজীবনের ছায়ার সঙ্গে মিলিয়ে নিবিড় পাঠের উদ্যোগ সূচিত হওয়ার। সেগুলি সম্ভবত বাহ্য কাহিনিগুলির থেকেও রোমাঞ্চকর।
|
|
|
|
|
|