|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
হাল্কা, ফুরফুরে করে বলা গল্প |
গৌতম চক্রবর্তী |
মহারানি, রাস্কিন বন্ড। পেঙ্গুইন ভাইকিং, ২৯৯.০০
রাস্কিন বন্ড: দ্য মসুরি ইয়ার্স, গণেশ সাইলি। নিয়োগী বুকস, ১৪৯৫.০০
|
এই ছোট্ট উপন্যাস বা ‘নভেলেট’টির নায়িকা এক মদ্যপ, যৌন-বুভুক্ষু মহারানি। পোশাক ছাড়ার মতোই তিনি ঘন ঘন প্রেমিক বদলান। তারা কেউ বলিভিয়ার রাষ্ট্রদূত, কেউ পিয়ানোবাদক, কেউ বা সুইজারল্যান্ড থেকে আসা মুষকো জোয়ান। আল্পস পাহাড়ের দেশ থেকে হিমালয়ে সাধু হতে এসে রানির বডিগার্ড বনে গিয়েছে। রানির দুই ছেলে। বড়টি মাতাল, ছোটটি পাতাখোর। যৌন হিংসা থেকে একটি খুনও রয়েছে। কত বছর বাদে বড়দের উপন্যাস লিখলেন রাস্কিন বন্ড?
মাতাল মহারানির পাশাপাশি রাস্কিন বন্ডের নতুন উপন্যাসে একটি বাচ্চা ভূত আছে। আছে কবরখানা এবং বাড়ি থেকে পালিয়ে সিনেমা হলে বসে-থাকা এক বিষণ্ণ বালক। আছেন জিম করবেট এবং গুপ্তচর মাতাহারিও। আর আছে বদলে-যাওয়া মুসৌরি শহর। গল্পের মধ্যে ওক, মেপ্ল আর দেওদার গাছের গন্ধ ভেসে আসে। ম্যাগপাই আর বুলবুল পাখি উড়ে বেড়ায়। চার পাশের সমস্যা ভুলে যায় পাঠক, নিজেকে তার বেশ হাল্কা আর ফুরফুরে লাগে।
রাস্কিন বন্ড নিজেই এই উপন্যাসের এক চরিত্র। ছোটবেলায় তিনি সিমলায় ছেলেদের স্কুলে। পাশে মেয়েদের স্কুলে নিনা। স্কুলের সোশ্যালে নিনাকে ঝটিতি চুমু খেয়েছিল বালক রাস্কিন, পরে দুটি প্রেমপত্রও লিখেছিল। উত্তর আসেনি। কারণটাও বলে দিয়েছিল এক বন্ধু, ‘নিনা বলেছে, তোর মুখে ব্রণ’। রাস্কিন বন্ড পড়তে ভাল লাগে কেন? ‘সিমলায় আমাদের স্কুলটাকে ‘প্রাচ্যের ইটন’ বলা হত। তবে ওটা রাগবি স্কুলের এক ছাত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন,’ উপন্যাসে লিখছেন রাস্কিন। হ্যারো, ইটন, রাগবি... পাবলিক স্কুলের হারিয়ে-যাওয়া স্বর্ণযুগ মনে পড়িয়ে দেন রাস্কিন। স্কুলের ছেলেরা সোশ্যালে মেয়েদের সঙ্গে কী নাচবে ভাবে। ওয়ালত্জ নাচতে গেলে স্টেপিংসে দক্ষতা থাকা চাই। তার চেয়ে বরং ফক্সট্রট ভাল।
এই নিনাই পরে বড় হয়ে, মস্তিপুরের মহারানি। মহারাজার ইচ্ছে ছিল, একটা বাঘ পুষবেন। প্রাসাদের বাগানে ঘুরে বেড়াবে। ঢোল রাজ্যের রাজা সিংহ পোষেন, আর মস্তিপুর বাঘ রাখবে না? অতএব, তিনি জিম করবেটকে ডেকে পাঠালেন। তার পর? উপন্যাস থেকে অনুবাদ করে দিচ্ছি: ‘করবেট মানুষখেকো শিকারে হাত পাকিয়েছিলেন (ওঁর বইয়ে সে রকমই বলেছেন), কিন্তু রাজ-রাজড়াদের পরিষেবা দিতেও উন্মুখ ছিলেন। রাজারাও ওঁকে ভিআইপি শিকার পার্টিতে রাখতেন। যেমন, বড়লাট লর্ড লিনলিথগোর শিকার পার্টি। কয়েকটি বাঘকে খেদিয়ে ভিআইপি শিকারির দিকে নিয়ে যাওয়া হয়, তিনি হাতির পিঠে নিরাপদ হাওদায় বসে গুলি চালান। যদি মিস হত (প্রায়ই তা ঘটত), করবেট মোক্ষম গুলিটি চালাতেন এবং মাননীয় অতিথি বাঘ মেরেছেন বলা হত। বেচারি করবেটকেও বেঁচে থাকার জন্য রোজগার করতে হত।’ হাল্কা, ফুরফুরে ভঙ্গিতে ‘আসল’ গল্পটি বলে দিলেন রাস্কিন বন্ড।
রাজা শিকারে গেলে প্রাসাদ কী করে? মহারানি সুদর্শন এক ড্রাইভারকে নিয়ে এখানে-সেখানে চলে যান। ‘হিজ হাইনেস যখন বাঘের দেখা পেতে তরাইয়ের জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান, তাঁর মোটরচালক প্রভুর গুহায় একটি জ্যান্ত বাঘিনিকে পোষ মানায়,’ জানাচ্ছে উপন্যাস। সহজ সরল একটি বাক্য, তার মধ্যেই দুষ্টুমিভরা কৌতুক। রাস্কিন বন্ডের লেখার বৈশিষ্ট্য এই রকমই। |
|
মস্তিপুরের এই মহারাজা মারা গেলেন কী ভাবে? তাঁর হবি, সাদা ইঁদুর পোষা। প্রাসাদের এক অংশে কয়েকশো সাদা ইঁদুর ছিল তাঁর। ইঁদুরদের জন্য সেই ঘরে টয়ট্রেনও ছিল। রাজা এক রাতে প্রচুর হুইস্কি টেনেছেন। তার পর ইঁদুরদের ঘরে গিয়ে দেখলেন, সারা দিন তাদের খেতে দেওয়া হয়নি। মাতাল রাজা কিছুক্ষণ পরে টুল থেকে পড়ে গেলেন। একটি রাগী, ক্ষুধার্ত ইঁদুর কুটুস করে তাঁর গায়ে কামড়ে দিল। মহারাজার জ্ঞান নেই, কিন্তু ইঁদুরেরা সবাই জেনে গেল, তাদের প্রভু খুব সুস্বাদু। পরদিন সকালে ভৃত্য এসে দেখল, মেঝেতে শুয়ে আছে রাজপোশাক-পরা এক কঙ্কাল। মাংস, চামড়া সবই গিয়েছে ক্ষুধার্ত ইঁদুরদের ভোজনে।
এ সবের মধ্যেই আসে পাহাড়ি শহর। পুরনো কিপলিং রোডের পাশে মানুষের চাপে ফুলেফেঁপে বাজার হয়ে ওঠে একদা ছিমছাম বার্লোগঞ্জ। বালা হিসার এস্টেটে স্কুলপড়ুয়াদের ভিড়। রিয়াল্টো, ম্যাজেস্টিক সিনেমাহলের দেওয়ালে মেরিলিন মনরো, জন ওয়েন, হেমামালিনীর পোস্টার। পুরনো রিকশাগুলি আর নেই, শহরে শুধুই মোটরগাড়ির ভিড়। বিখ্যাত এক হোটেল এখন প্রায় ধ্বংসস্তূপ। বাবুর্চি থেকে ম্যানেজার সবাই বিদায় নিয়েছে। উপন্যাসে নাম না থাকলেও অক্লেশে বলা যায়, বন্ধ হয়ে-যাওয়া স্যাভয় হোটেলই এটির মডেল।
পুরনো মসুরি চেনা বা না-চেনা নয়। উপন্যাসের শেষে নিঃসঙ্গ নিনা, যৌবনের খেয়ালখুশি এবং প্রেমিকের দল সকলে তাকে ছেড়ে গিয়েছে। বার্লোগঞ্জে তার ‘হলো ওক’ প্রাসাদ ধূলিধূসরিত, সিনেমার শুটিং-এর জন্য ভাড়া দেওয়া হয়। মাঝে মাঝেই বন্ধু রাস্কিনকে ডেকে পাঠায়, আলমারির লুকনো বাক্স থেকে হিরে-মুক্তো-জহরত বের করে দেখে। দুই ছেলের ওপর রাগে বারে বারেই উইল বদলায় সে, ঝগড়াটে ভঙ্গিতে ছোটবেলার বন্ধু রাস্কিনকে বলে, ‘তোকে কেন অপছন্দ করি, জানিস? তুই অল্পেই সুখী।’ সুখ খুঁজতে পণ্ডিচেরিতে হোটেল চালানো থেকে ভিনদেশি, বিবাহিত প্রেমিককে নিয়ে কাঠমান্ডু উড়ে যাওয়া, হৃষীকেশে সাধুসঙ্গ, কত কী যে করেছে নীনা! নিজেকেই সবচেয়ে ভালবেসেছে সে, ছেলেপুলেরাও তুচ্ছ তার আত্মসুখী প্রেমের কাছে। রাস্কিন বন্ড মোলায়েম ভঙ্গিতে গল্প বলে যান, কখনও ‘ভ্যালু জাজমেন্ট’ দেন না। বরং গল্পের শেষে নিনার অসহায় মৃত্যুতে পাঠকের চোখ আর্দ্র হয়ে ওঠে। জীবনে স্বার্থপরতা, হিংসুটে ভাব থাকতেই পারে। কিন্তু ছেলেবেলার বন্ধুত্ব আকাশের মতো উদার। কালো মেঘ জমাট বাঁধে না, মৃত্যু এসে দমকা হাওয়ার মতো তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়, স্মৃতির আইভিলতায় টুপটাপ পাহাড়ি বৃষ্টি নামে।
পুজোয় এ বার দেরাদুন-মসুরির টিকিট না পেলেও ক্ষতি নেই। হাতের পাশে ‘মহারানি’ থাকলেই হল!
আর পাঁচটা ‘কফি টেব্ল’ বইয়ে যেমন হয়, গণেশ সাইলির বইয়ে সে রকম চমৎকার কিছু ছবি আছে। কখনও ল্যান্ডোরের রাস্তায় হেঁটে বেড়াচ্ছেন রাস্কিন বন্ড। কখনও বা ঝিন্দের মহারানি পৃথ্বীবীর কাউর, বিল এইটকেন ও রাস্কিন আড্ডা মারছেন মহারানির ‘ওকলেস’ বাংলোয়। এই বাংলো আর বন্ধু মহারানিই কি লেখকের মনের আয়নায় ভেঙেচুরে তৈরি হয়েছে নতুন মহারানি উপন্যাস? রয়েছে বাগানে জল দেওয়া, তুঙ্গনাথ ট্রেক, ভিক্টর ও অন্য বন্ধুদের সঙ্গে মজা করার বিভিন্ন মুহূর্ত। রয়েছে রাস্কিনের মা-বাবার বিয়ের ছবি, ছেলেবেলায় সিমলার হোস্টেল থেকে বাবাকে লেখা চিঠি ও অনেক কিছু। গণেশ রাস্কিনের অনেক দিনের বন্ধু, দু’ জনে মিলে রান্নার বইও লিখেছিলেন। ছবির ফাঁকে ফাঁকে ছড়িয়ে আছে অনেক মজাদার ঘটনা। ট্যাক্সিতে দেরাদুন থেকে মসুরির দিকে যাচ্ছেন রাস্কিন। সহযাত্রী মহিলার হাতে রাস্কিন বন্ডের বই। রাস্কিন উচ্ছ্বসিত, ‘আরে, আমার বই!’ মহিলা রেগে ভ্রুকুটি করলেন, ‘কে বলল, আপনার বই? আমি একটু আগে কিনলাম!’ সব ছবিই যে নতুন, এমন নয়। গণেশ সইলির মসুরি মেডলে বা রাস্কিন: আওয়ার এনডিয়োরিং বন্ড বইয়েও অনেক ছবি ছিল। তবু মসুরির পাহাড়, টেহরি গহঢ়বালের সবুজ আর রাস্কিন বন্ড তো পুরনো হয় না। |
|
|
|
|
|