|
|
|
|
নিবন্ধ ২... |
পঞ্চতন্ত্রর পাঁচালি |
সেক্টর ফাইভ। দশটা-পাঁচটা নয়। সারাদিন কাজ। কলকাতার মধ্যে এ যেন অন্য শহর।
পার্টি, কাজ পাশাপাশি। তার অলিগলিতে, রাজপথে ঘুরে বেড়ালেন শতরূপা বসু |
একটা সপ্তাহ। ২৪x৭। খ্যাপা দৌড়। খড়খড়ে ম্যাপে এই ‘জোন’ কলকাতা থেকে মাত্র কিছু কিলোমিটার দূরে। কিন্তু কলকাতা যদি মার্স হয় এই ‘জোন’টা ভেনাস।
সেক্টর ফাইভ। এক কলকাতার মধ্যেই আরেক কলকাতা।
জাম্প কাট।
সারা দিন তার অলি-গলির ওপর টক্কর চলে দেশি গাড়ির সঙ্গে মার্সেডিজের। এ তো গেল সোম থেকে বৃহষ্পতিবার। কিন্তু শুক্রবার? গায়ে আঁটা ঘোরতর কর্পোরেট ‘ফ্রাইডে ড্রেসিং’। কিন্তু মুখে মুখে ঘুরতে থাকে ‘হ্যাভ আ নাইস উইকেন্ড’। অপেক্ষা সন্ধের। ঘড়ির তীব্র শাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ‘রেজিমেন্টেড’ দৃষ্টির মদির উৎসব।
সন্ধে ৭.৩০টা: ‘ডু ইউ পার্টি?’
ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতেই দেখা দেবলীনার সঙ্গে। ফুচকা খেতে হাঁ করতে যাবে ওমনি খপ। “আমি কাজ করি আর এস সফট্ওয়্যারে। রোজ বাড়ি ফেরার আগে এখানে ফুচকা খাই।” শুক্রবার রাতে শুকনো ফুচকা? হিহি হাসে দেবলীনা। “যাই তো পার্টিতে। অফিস কলিগদের সঙ্গে মাঝে মাঝে। আজ ওরা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেছে। তাই আমার ফুচকাই জয় হো...।” একটু এগোতেই এক নামী রেস্তোরাঁয়। প্রায় এক ডজন ফ্যামিলি মেম্বার নিয়ে বসে আছে ড্যানিয়েল। ড্যানিয়েল হং। থাকেন ট্যাংরায়। কাজ করেন এক চাইনিজ বিদ্যুৎ সরবরাহ সংস্থা ফার্ম সেপকো থ্রি-তে। “আমি একশো পার্সেন্ট চাইনিজ।” কিন্তু কলকাতায় চাইনিজের আঁতুড়ঘর ট্যাংরা ছেড়ে সেক্টর ফাইভে চিকেন ভর্তা? সমস্বরে দলের হুঙ্কার, “মুখ বদল করতে ট্যাংরায় এসেছি।” আবার ড্যানিয়েলের ফচকেমি, “ডু ইউ পার্টি? আমার পরের স্টপ বার-বি-কিউ নেশন। চিকেন অ্যান্ড প্রন কাবাব।”
সাড়ে চার ঘণ্টা ডাউন দ্য ড্রেন। রিয়েলি?
গোটা জীবনটাই যেন পার্টি এখানে। ইনফিনিটি বিল্ডিং, আই বি এম, কগনিজেন্ট... বহুতল সব মাল্টিন্যাশানাল অফিস সার দিয়ে দাঁড়িয়ে। ইনফিনিটি বিল্ডিংয়ের পেছনেই এলাকার ‘হট স্পট’। খাতায়-কলমে সেই পার্টির সময় ছেঁটে দেওয়া হয়েছে পাক্কা সাড়ে চার ঘণ্টা। ভোর ৪টে থেকে রাত ১১.৩০টা। নতুন সার্কুলার জারি হয়েছে এ বছর ১৯ জুন। সঙ্গে জুড়েছে আরও নিয়ম। প্রত্যেক লাউঞ্জ, বার-কাম-রেস্তোরাঁয় ঢোকার, বেরোবার আর ভেতরের ভিড়ের মধ্যে নজর-ক্যামেরা মাস্ট। আর সমস্ত পার্টি সেরে ফেলতে হবে রাত ১১.৩০-টার মধ্যে।
এই সবই করা হয়েছে নিরাপত্তার কারণেই, বলছেন বিধাননগর পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার। “শুধু পার্ক স্ট্রিট বা মধ্য কলকাতা নয়। কলকাতার আশেপাশে, মানে দমদম বা সল্ট লেক, সব জায়গাতেই একই নিয়ম।”
হতে পারে “একই নিয়ম”। কিন্তু ‘স্পিরিট’ বলছে ঠিক তার উল্টোটা। অফিস শেষে ঠেঙিয়ে শহরের সব থেকে হট পার্টি জোন পার্ক স্ট্রিট যাওয়ার শক্তি উধাও। কলকাতার ‘একমেবাদ্বিতীয়ম’ পার্টি জোনের দিকে আঙুল তুলবে এমন স্পর্ধা অবশ্য এই জোন এখনও দেখাচ্ছে না। কিন্তু নিজস্ব একটা অস্তিত্ব এর মধ্যেই বানিয়ে ফেলেছে। ‘ঠেক’ও আছে বেশ কয়েকটা। গো হোয়ার। ওপিয়াম। একটু দূরে, লেক লাইট। বার কাম রেস্তোরা।ঁ হিং। শিমার্স। এক্স-ও-এক্স-ও। জেনারেশন ওয়াই বা জেন ওয়াই-য়ের নয়া মন্ত্র। মানে করলে দাঁড়ায় হাগস্ অ্যান্ড কিসেস। আলিঙ্গন আর চুমু। শিমার্স আর এক্স-ও-এক্স-ও ডিস্কোথেক। হালকা নীল আলোতে রহস্যময়। তীব্র লেজার আলো বার-এ সাজানো পানীয়র বোতলের কাঁচের গায়ে ছলকে পড়ছে। উঠছে ঘূর্ণি। চোখে লাগছে ধাঁধা।
রাত ১০টা: উইমেন বন্ডিং
জীবন এক বার। সিজ দ্য মোমেন্ট। এখনই। মুহূর্তের স্বাদ একেক জন নেয় একেক ভাবে। কেউ খাবারের ভক্ত। ‘ক্রিস্পি চিকেন ইন রেড চাইনিজ সস। দুটো হুইস্কিতে নেড়েচেড়ে। টু পেগস্ আ ডে, কিপস্ দ্য ডক্টর অ্যাওয়ে,” এবিবি লিমিটেড-এর অনির্বাণ শিকদারের দাওয়াই। কেউ বা ‘অম্বিয়েন্স’-এর। প্রিয় বান্ধবীদের সঙ্গে নির্ভেজাল সময় কাটানো। চিত্রলেখা, পায়েল, অমৃতা। তিন মূর্তি। চিত্রলেখার নিজস্ব ইন্টিরিয়র ডেকরেশনের সংস্থা। অ্যাক্সিয়ম ইন্টিরিয়রস। সেখানেই কাজ করেন পায়েল, অমৃতা। শুধু মাত্র মহিলা কর্মীদেরই নিয়োগ করেন চিত্রলেখা। “সব অফিসেই তো পুরুষের সংখ্যা বেশি। তাই একটু ব্যালেন্স করার চেষ্টা আর কী! মাসে দু’বার চিল আউট আসি,” চিকেন ৬৫-এ কামড় নিয়ে বললেন চিত্রলেখা।
রাত ১১টা: ক্লাইম্যাক্স
দাঁড়িয়ে আছে ব্ল্যাক ম্যাজিক ওম্যান। স্ট্র্যাপট ড্রেস জড়িয়ে। পায়ে চটি। আজানুলম্বিত ঘন খয়েরি জটা। এলোমেলো। সাড়ে পাঁচ বছর চিরুনি না ছোঁয়া চুল। তার মাঝখান থেকে ঠেলে বেরিয়েছে এক কান-এঁটো করা ঝলমলে হাসির মুখ। ডান হাতে লাল টকটকে বিপত্তারিণীর মায়াডোর। ফটোগ্রাফার মধুমিতা নন্দী নিজেই বাকিদের ফ্রিজ-ফ্রেম করে দিয়েছেন। এসেছেন বন্ধুদের নিয়ে। এক্স-ও-এক্স-ও তে লাইভ ব্যান্ড শুনতে। ক্যাসিনিজ ডিভিশন-এর গান। এই সময়ের প্রথম সারির ইংরেজি অলটার্নেটিভ রক ব্যান্ড। দরজা ঠেলে ঢুকে দেখা গেল গাইছেন রাহুল গুহ রায়। ব্যান্ডের প্রধান গায়ক। সামনে ডান্স ফ্লোরে দর্শক। গানের মাঝে রাহুলের র্যাপের ধ্বনির সঙ্গে মিলিয়ে সমস্বরে গলা মেলানো। কান-ফাটনো পার্কাসানস্, গিটারের ডিস্টরশান, গানের কথা লেজারের ঝিকোনো আলোর মধ্যে, সিগারেটের ধোঁয়ার মধ্যে জড়িয়ে-মড়িয়ে যাচ্ছে। বুদবুদ হয়ে উড়ে যাচ্ছে সব। ডি-জে (ডিস্ক জকি) রাজ-এর গানের সঙ্গে ‘ক্লোজ- ডান্সে’ মগ্ন এক কাপল্। একটু দূরে আস্তে আস্তে দুলছে ব্ল্যাক ম্যাজিক ওম্যান। জটা গলে পড়ছে লাল-নীল আলো হয়ে।
রাত ১২টা। সিন্ডারেলা আওয়ার। না লাস ভেগাস?
রাত ১২টার ঘণ্টা শোনাবে সেই বিগ বেন এখানে নেই। যে বলবে এ বার পার্টি জোনের ঘুমোনোর পালা। কিন্তু ঘুম? রাত সাড়ে বারোটায় কলেজ মোড়ের সামনে ব্যাঙ্কের এটিএম-এ লম্বা লাইন দেখে মনে ধাঁধা লাগে এটা কলকাতা তো? না লাস ভেগাস?
‘ফাস্ট লেন’-এর এক দিকের ফুটপাতেই নিতাই-এর ধাবা। তাওয়া-গরম রুমালি-তন্দুরি রুটি। অ্যালুমিনিয়াম ট্রে-তে সবজি তড়কা। ডেকচিতে ডিমের তড়কা। তারিয়ে খাচ্ছেন কয়েকজন বিপিও-কর্মী। তাঁদের তো সবে ‘দিনের’ শুরু। একজন প্যাক করে নিয়ে গেলেন রাত দেড়টার ‘লাঞ্চ’!
পাশেই নামী ব্র্যান্ডের চা আর কফির দোকান। টি-জংশন। বারিস্তা। পাল্লা দিয়ে তারাও চলছে টোয়েন্টি ফোর-সেভেন। ভিড় বাড়ছে সেখানেও। কেউ বা মাঝরাতের ফ্লাইট ধরবার আগে স্ন্যাকস্ আর কফিতে চুমুক দিতে ঢুকছেন। “আমাদের বিভিন্ন শিফ্টে কাজ হয়। আমি (রাত) ১০-টা থেকে ডিউটি শুরু করলাম। ভোর পাঁচটায় শেষ,” বললেন টি-জংশনের এক কর্মী।
পাশেই রাস্তার চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে তমসুক, কিরণ, অমিত, পিনাকী। শ্রেই বিএনপি পারিবা-এ কাজ করার ফাঁকে চা খেতে নেমেছে। “সন্ধে থেকে চা খাওয়ার এটা আমাদের চতুর্থ শিফট,” সিগারেটে সুখটান দিয়ে বলল তমসুক।
ভোর ৪টে
ফ্লাইট ধরবার জন্য আপনার গাড়ি ছুটছে হুহু করে এয়ারপোর্টে। ঝলসানো আলোর ফুটকির মধ্যে চোখ ধরছে কত ছবি। ইনফিনিটি বিল্ডিং। ব্যস্ত ধাবা। সর্পিল এটিএম-এর লাইন। ‘ইয়ং ব্লাডের’ জটলা। এদের মধ্যেই হয়ত কেউ তমসুক। বা অমৃতা। বা মধুমিতা...
|
|
|
|
|
|
|