|
|
|
|
নিবন্ধ ১... |
ডাক্তার যখন কুমার শানু |
ঘটে গেল অভাবনীয় ঘটনা। লিখছেন সংযুক্তা বসু |
ছিলেন গায়ক। হয়ে গেলেন ডাক্তার। এই ভাবেই সংজ্ঞা দেওয়া যায় ঘটনাটার। কার জীবনে এমন হল? তিনি কুমার শানু।
‘১৯৪২ লাভ স্টোরি’ ছবিতে রাহুল দেব বর্মনের সুর দেওয়া এবং কুমার শানুর কণ্ঠে গাওয়া ‘কুছ না কহো কুছ ভি না কহো’ গানের সুরের মূর্ছনায় হেসে উঠল এক যুবক।
চোখ-মুখে প্রফুল্ল ভাব। বয়স পঁচিশ। নাম অভিষেক মিত্র। জন্ম থেকেই সেরিব্রাল পলসি রোগের শিকার। সেরিব্রাল পলসির অর্থ হল শরীর ও মস্তিষ্কের জন্মগত নানা ধরনের অসাড়তা। সেই অসাড়তা ভেঙে গেছে কুমার শানুর গানে। যখনই ওই গান বেজে ওঠে ‘কুছ না কহো, কুছ ভি না কহো’ অভিষেক মেরুদণ্ড টানটান করে সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করে। মুখভঙ্গির মধ্যে সঞ্চারিত হয় ভাললাগার আবেগ। যেন সে প্রাণবন্ত জীবনকে নতুন করে ছুঁয়ে ফেলে। যেন সে আর পাঁচটা মানুষের মতো স্বাভাবিক হতে চায়।
তার সমস্ত পঙ্গুত্ব ,জড়তা ঘুচে যেতে চায় কুমার শানুর ওই এক গানে। তাঁর বাবা-মা যত বার এই গান শুনিয়েছেন পুত্র যেন কথা বলতে চেয়েছে, প্রকাশ করতে চেয়েছে তাঁর মনের কথা। ‘কুছ না কহো’ শুনে ছেলের এই অভাবনীয় পরিবর্তন দেখে একদিন বাবা গৌতম মিত্র স্বয়ং এ গানের গায়ক কুমার শানুকে যোগাযোগ করে জানালেন এই অলৌকিক ঘটনার কথা।
কুমার শানু শুনে বিস্মিত। বললেন, “তার পর নিজে চোখে দেখলাম সে ঘটনা। গত বছর যোধপুর পার্কে বাণেশ্বর শিবমন্দির দুর্গোৎসবে দেখা হল অভিষেকের সঙ্গে। অভিষেকের এক পাশে বসে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন অন্য পাশে আমি। যেই ‘কুছ না কহো’ গাইলাম, সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটির মুখে চোখে খুশি ঝরে পড়ল। আশ্চর্য! আশ্চর্য হয়ে গেলাম আমি। এ কী অসাধারণ ঘটনা।”
কুমার শানুর কাছে সেই মুহূর্তে ঘটনাটা অলৌকিক মনে হলেও ডাক্তারি শাস্ত্র অনুসারে এমনটা হওয়া ভিত্তিহীন নয়। নিউরোলজিস্ট বা স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ প্রসেনজিৎ সেনগুপ্ত জানালেন, মস্তিষ্কের এবং শরীরের এই জন্মগত রোগ সারাতে আজকাল মিউজিক থেরাপি কিছু কিছু ক্ষেত্রে খুব ভাল কাজ করছে। এর একটা বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে।
কুমার শানু মনে করেন ‘কুছ না কহো’ গানের মধ্যে দিয়ে এমন কিছু শব্দতরঙ্গ তৈরি হয়, যা হয়তো এই ছেলেটির মস্তিষ্কের অকেজো কোষগুলোকে ক্ষণিকের জন্য হলেও স্বাভাবিক করে তোলে।
তা কেমন লাগছে শানুর হঠাৎ গায়ক থেকে ডাক্তার হয়ে ওঠার এই জীবন্ত রূপকথার ঘটনায়? |
আগে |
|
পরে |
|
|
শানুর গানে সাড়া দিল সেরিব্রাল পলসিতে
আক্রান্ত যুবক। |
|
গাঢ় আবেগঘন গলায় তাঁর উত্তর “বহু পুরস্কার জীবনে পেয়েছি। ছোট বড় মিলিয়ে শ’পাঁচেক পুরস্কার আমার বাড়িতে আছে। সেই সঙ্গে পেয়েছি শ্রোতাদের প্রচুর ভালবাসা। কিন্তু গান গেয়ে কারও প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার এই যে পুরস্কার পেলাম তা বাকি সব পুরস্কারকে যেন ছাপিয়ে যায়।”
এই সুবাদে সম্প্রতি কুমার শানু ‘বিশ্ববন্ধন ফর সেরিব্রাল পলসি’ সংস্থার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হয়েছেন। দেশ-বিদেশে গিয়ে সেরিব্রাল পালসি রোগে আক্রান্ত সন্তানদের পরিবারের মানুষজনকে সচেতন করবেন তিনি। কখনও গান শুনিয়ে কখনও বা যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতায়। এই সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা তথা সভাপতি অভিষেকের বাবা গৌতম মিত্র বললেন, “মহম্মদ রফি, কিশোর কুমার এমন কত গায়কেরই গান বাজে বাড়িতে। কিন্তু অসাধ্যসাধন করে আমার ছেলেকে যেন প্রাণ দিলেন কুমার শানু। সেই জন্যই আমাদের সংস্থার ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর করেছি ওঁকে।”
শুধু যে কুমার শানুর গাওয়া একটা গানেই এমন অসাধ্যসাধন হচ্ছে তা নয়, আরও একটি গান রুগিদের মনে আনন্দ ফিরিয়ে আনছে।
‘জুর্ম’ ছবিতে তাঁর গাওয়া, মুখে মুখে ফেরা গান
“জব কোই বাত বিগড় জায়ে
জব কোই মুশকিল পড় যায়ে
তুম দে না সাথ মেরা ও হামনবাজ”.....
এই গানটিও রুগিদের মধ্যে ফিরিয়ে আনে জীবনের আশা। “পৃথিবীর ২৪০টি দেশে সাড়া জাগিয়েছে এই গান। ভারতীয় রুগিদের মিউজিক থেরাপিতে এক নম্বরে রয়েছে এই গান। আমি এক ক্যান্সার আক্রান্ত ভদ্রমহিলাকে জানি, যিনি এ গান শুনে বেঁচে থাকার শক্তি পেয়েছেন। যখনই শরীরে যন্ত্রণা পান বা মন খারাপ হয়, এই গান শুনে চাঙা হয়ে ওঠেন”, পরিতৃপ্তির গলায় বললেন কুমার শানু।
এ বার পুজোয় কুমার শানুর গানের চারটি অ্যালবাম বাজারে আসছে। কিন্তু শানু চান সাধারণ শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের পাশাপাশি এমন গান গাইতে যা মানুষের হতাশা দূর করবে। মানসিক অবসাদ থেকে মুক্ত করবে। “এই রকম গান গেয়ে যদি মানুষের মনে শান্তি দিতে পারি সেটাই হবে জীবনের সবচেয়ে বড় পাওনা।” বললেন কুমার শানু।
কুমার শানুর জীবনে যা ঘটে গেল তা যেন সত্যিই গানের ভিতর দিয়ে ভুবন দেখানোর গল্প... |
|
|
|
|
|