|
|
|
|
|
|
...সময় এল কাছে |
বাড়ি-ধারা
কোথাও দশভূজা কোথাও বা অভয়া দুর্গা।
বনেদি বাড়ির পুজো বৈচিত্রের সন্ধানে গৌতম বসুমল্লিক |
|
|
মল্লিকবাড়ি, ভবানীপুর |
সুশীলমাধব, প্রিয়মাধব ও সুরেন্দ্র মল্লিক— তিন ভাই ১৯২৫-এ মোহিনীমোহন রোডের বাড়িতে ঠাকুরদালান নির্মাণ করে দুর্গাপুজো আরম্ভ করেন। সাবেক একচালা মহিষাসুরমর্দিনী ডাকের সাজের প্রতিমা হলেও আলাদা করে সোনা ও রুপোর গয়না পরানো হয়। কাঠামো পুজো হয় জন্মাষ্টমীর দিন। প্রতিপদাদিকল্প অনুসারে মহালয়ার পরের দিন আরম্ভ হয় বোধন। পুজো হয় ‘বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা’ অনুসারে। পশুবলি হয় না। কুমারীপুজো হয়। অন্নভোগের প্রচলন নেই। চাল, ডাল, বিভিন্ন ফল ও মিষ্টান্ন এবং লুচি, ভাজা দেওয়া হয় নৈবেদ্য ও ভোগ হিসেবে। নবমীর রাত্রে বাড়ির সদস্যদের থিয়েটার এই বাড়ির উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান। বিসর্জন হয় আদিগঙ্গায়। বিজয়ার রাতে বসে পুরাতনী গানের আসর। ইকমিক-কুকারের আবিষ্কর্তা চিকিৎসক ইন্দুমাধব মল্লিক, বাংলা চলচ্চিত্রশিল্পী রঞ্জিত মল্লিক ও কোয়েল মল্লিক এই পরিবারের সদস্য।
|
অক্রূর দত্তের বাড়ি, ওয়েলিংটন স্কোয়ার |
ওয়েলিংটন দত্ত পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা অক্রূর দত্ত অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্য ভাগে হুগলি-পাণ্ডুয়ার সোনাটিকরি গ্রাম থেকে ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় আসেন। ক্রমে তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা আরম্ভ করেন। দুর্গাপুজো আরম্ভ করেন তিনিই। পরবর্তীকালে তাঁর উত্তরপুরুষ কালিদাস দত্ত, রাজেন দত্ত আমেরিকানদের সঙ্গেও ব্যবসা করেন। নীল, সোরা, নুন প্রভৃতি বহুবিধ সামগ্রী নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন তাঁরা। আনুমানিক ১৭৬৬-৬৭তে নির্মিত হয় পাঁচ খিলানের দু’দালান বিশিষ্ট ঠাকুরদালান-সহ দত্তদের পারিবারিক ভদ্রাসন। এই বাড়িতেই (১৮/৪ অক্রূর দত্ত লেন) ছিল ‘সাবিত্রী লাইব্রেরি’। রবীন্দ্রনাথ-সহ সে যুগের বহু বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব যুক্ত ছিলেন ওই গ্রন্থাগারের সঙ্গে। ১৯০৫-এ স্বদেশি আন্দোলনের সময়ে বঙ্গভঙ্গের দিনে (১৬ অক্টোবর) যে ‘রাখি বন্ধন’ হয়েছিল তার প্রথম প্রস্তাব নেওয়া হয় ওই লাইব্রেরি থেকেই। দত্তদের সাবেক ভদ্রাসনটিও এখন আর নেই। সেই জায়গায় তৈরি হয়েছে বহুতল বাড়ি। সাবেক একচালা ডাকের সাজের মহিষাসুরমর্দিনী প্রতিমা। কাঠামো পুজো হয় রথের দিন। ষষ্ঠাদিকল্পে পুজো, তাই ষষ্ঠীর দিনে হয় বোধন। কলাবউ স্নান হয় বাড়ির ঠাকুরদালানেই। আগে পশুবলি হলেও এখন আখ ও ছাঁচিকুমড়ো বলি দেওয়া হয়। নৈবেদ্য হিসেবে দেওয়া হয় চাল, ডাল, বিভিন্ন ফল ও মিষ্টান্ন। দশমীর সকালে অপরাজিতা-পুজো হয়।
|
চন্দ্রবাড়ি, ওয়েলিংটন স্কোয়ার |
চন্দ্র পরিবারের সদস্যরা অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে নদিয়া জেলা থেকে কলকাতায় এসে সাবেক ডিঙাভাঙা অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। পরিবারের এক উত্তরপুরুষ, সে যুগের স্বনামধন্য আইনজীবী গণেশচন্দ্র ১৮৭৭ থেকে সাবেক ওয়েলিংটন স্ট্রিটের ভদ্রাসনে (বর্তমান ঠিকানা ২৩ নির্মলচন্দ্র স্ট্রিট) দুর্গাপুজো আরম্ভ করেন। গণেশচন্দ্রের পৌত্র নির্মলচন্দ্র ছিলেন বিংশ শতাব্দীর বাংলার এক জন প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতা। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী প্রতাপচন্দ্র চন্দ্র এই পরিবারের সন্তান। ভারতীয় স্থাপত্য রীতিতে তৈরি চন্দ্রবাড়ির দু’দালান ও তিন খিলানের ঠাকুরদালান নির্মাণ করেন সে যুগের প্রখ্যাত স্থপতি শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। চন্দ্রবাড়ির সাবেক একচালা ডাকের সাজের মহিষাসুরমর্দিনী প্রতিমা এক সময়ে বাড়িতেই তৈরি হত, এখন কুমোরটুলি থেকে তৈরি করিয়ে আনা হয়। প্রতিপদাদিকল্পে পুজো, অর্থাৎ, মহালয়ার পরের দিন থেকে আরম্ভ হয় বোধন। সন্ধিপুজোর সময়ে দক্ষিণাকালীর মন্ত্রে দুর্গার পুজো হয়। চন্দ্রবাড়ির পুজোয় সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এই তিন দিনেই কুমারীপুজো হয়। ছাঁচিকুমড়ো বলি দেওয়া হয়। চিত্তরঞ্জন দাশ, মোহনদাস গাঁধী, যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, সুভাষচন্দ্র বসু বিধানচন্দ্র রায়, আবুল কালাম আজাদ, রাজেন্দ্রপ্রসাদ, জওহরলাল নেহরু-সহ সেযুগের বহু নেতা ওই বাড়িতে এসেছেন বিভিন্ন সময়।
|
সেনবাড়ি, বৈঠকখানা |
শতবর্ষ স্পর্শ করল বৈঠকখানা সেনবাড়ির দুর্গাপুজো। সোনার ব্যবসায়ী নীলমণি সেন ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে যশোহর থেকে কলকাতায় এসে জ্যাকেরিয়া স্ট্রিট অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। সেখানে তিনি দুর্গোৎসব করতেন। নীলমণির প্রপৌত্র কানাইলাল সেন ১৩০ বৈঠকখানা রোডে ঠাকুরদালান-সহ একটি বাড়ি কিনে ১৯১৩ থেকে নতুন করে দুর্গাপুজো শুরু করেন। তিন খিলানের দু’দালান বিশিষ্ট ঠাকুরদালান। বাইরের দালানের সম্মুখভাগে খিলানগুলির উপরে ফুল-লতা-পাতার অলঙ্করণ রয়েছে। এখানকার প্রতিমা দ্বিভুজা অভয়া দুর্গা। পায়ের নীচে সিংহ। দুর্গার পাশে লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ ও কার্তিকের মূর্তি। কাঠামো পুজো হয় উল্টোরথের দিন। ষষ্ঠাদিকল্পে পুজো, অর্থাৎ ষষ্ঠীর দিন বোধন হয়। চাল, ডাল, বিভিন্ন ফল ও মিষ্টান্ন দেওয়া হয় নৈবেদ্য হিসেবে। শতবর্ষ উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছে নানা
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের।
|
গঙ্গাপ্রসাদ সেনের বাড়ি, কুমোরটুলি |
কুমোরটুলি সেন পরিবারের কলকাতা শাখার স্থপতি গঙ্গাপ্রসাদ সেন ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পিতা নীলাম্বর সেনের সঙ্গে ঢাকা থেকে কলকাতায় আসেন। অল্প বয়সে তাঁর পিতৃবিয়োগ হয়। মেধাবী গঙ্গাপ্রসাদ পারিবারিক কবিরাজী চিকিৎসাবিদ্যা শিখে চিকিৎসা আরম্ভ করেন। আর্থিক স্বচ্ছলতা এলে কুমোরটুলি অঞ্চলে জমি কিনে ঠাকুরদালান-সহ ভদ্রাসন নির্মাণ করে আনুমানিক ১৮৫৭ (১২৬৪ বঙ্গাব্দ) থেকে দুর্গাপুজো আরম্ভ করেন গঙ্গাপ্রসাদ। এই বাড়ির একচালা ডাকের সাজের মহিষাসুরমর্দিনী প্রতিমায় কার্তিক-গণেশ কিন্তু স্থান পরিবর্তন করে আছে একেবারে পূর্ববঙ্গীয় রীতি অনুসারে। পুজো হয় ‘কালিকাপুরাণ’ পুথিমতে ‘নবম্যাদিকল্প’ অনুযায়ী, অর্থাৎ, ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের নবমী তিথি থেকে আরম্ভ হয় বোধন, ষষ্ঠীতে অধিবাস। চালকুমড়ো, আখ ও ‘শত্রুবলি’ হয়। এই পুজোর বৈশিষ্ট্য হল অষ্টমীর রাতে দুর্গার সঙ্গে কালীপুজোও হয়, সেই সঙ্গে শীতলার ঘট বসিয়ে পুজো করা হয়। |
|
|
|
|
|