মূল্যবৃদ্ধির জেরে সমস্যায় মৃৎশিল্পীরা |
প্রকাশ পাল ও রমাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় • ডোমজুড় ও শ্রীরামপুর |
আসছে পুজো। বিভিন্ন এলাকার মৃৎশিল্পীদের মধ্যে এখন তুমুল ব্যস্ততা। দিনরাত এক করে দুর্গাপ্রতিমা গড়ে চলেছেন তাঁরা। কিন্তু মুখে হাসি নেই। উপকরণের দামবৃদ্ধিতে তাঁরা দিশাহারা। কারণ, লাভের অঙ্ক কমছে। মহাজনের ঋণ শোধ করা নিয়েও অনেকে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। ‘হাওড়ার কুমোরটুলি’ হিসেবে পরিচিত প্রশস্থ এবং হুগলির শ্রীরামপুরের চাতরা কুমোরপাড়াতেও একই ছবি।
ডোমজুড়ে মুম্বই রোডের অনতিদূরে মাকড়দহ রোডের ধারে অবস্থিত প্রশস্থ। এখানে ঘরে ঘরে চলে প্রতিমা তৈরির কাজ। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন পুজো কমিটির লোকজনের আনাগোনা শুরু হয়ে গিয়েছে। কারিগরেরা জলের বালতি, মাটি, তুলি নিয়ে প্রতিমা গড়ছেন। শিল্পীরা ব্যস্ত প্রতিমায় শেষবারের মতো মাটির প্রলেপ দিতে। কচিকাঁচারা এসে কারখানাগুলিতে ভিড় করছে।
পাশের মাঠে শরতের হাওয়ায় দুলছে কাশফুল। উৎসবের মেজাজ পুরোপুরি হাজির প্রশস্থে। এখানকার প্রতিমা হাওড়ার বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও হুগলি, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, কলকাতা প্রভৃতি এলাকায় যায়। দেশের নানা এলাকাতে এখানকার শিল্পীরা গিয়েও প্রতিমা বানিয়ে আসেন।
প্রতিমা তৈরিতে তাঁদের সুনাম ছড়িয়ে পড়লেও দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে বলে জানালেন শিল্পীরা। তাঁদের ক্ষোভ, প্রতিমা তৈরির উপকরণের দাম দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে। কিন্তু প্রতিমার দাম বাড়ানো যাচ্ছে না। ফলে, তাঁদের লাভের অঙ্ক কমে চলেছে।
শিল্পী অঞ্জন পাল বলেন, “গত বছর একটি বাঁশের দাম যেখানে ছিল ৮০ টাকা, এ বারে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৫ টাকায়। খড়ের বান্ডিল গতবারে ছিল ১৫ টাকা। এ বারে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ টাকায়। দড়ি গত বারে ছিল ৪০ টাকা প্রতি কিলোগ্রাম। এ বারে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৫ টাকায়। কারিগরের পারিশ্রমিক ছিল গত বারে ২৫০ টাকা। এ বারে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০০ টাকায়।” তাঁর ক্ষোভ, “কাঁচামালের দাম যে হারে বাড়ে, প্রতিমার দাম আমরা সেই হারে বাড়াতে পারি না। প্রতিমার দাম বাড়ালেই পুজো-উদ্যোক্তাদের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যায়।”
মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নিয়ে তাঁদের বেশির ভাগই প্রতিমা তৈরি করেন বলে জানান শিল্পীরা। তাঁদের বক্তব্য, এক মরসুমের ধার নেওয়া টাকা সেই মরসুমেই মেটাতে না পারলে পরের বারে ধার মেলে না। প্রতিমার দাম না বাড়াতে পারায় তাঁরা অনেক সময়ে মহাজনদের ধার শোধ করতে পারেন না। চণ্ডী চিত্রকর, শম্ভূ পাল, গণেশ চিত্রকর, অসিত হালদারদের মতো শিল্পীরা বলেন, “প্রতিমার দাম সে ভাবে বাড়াতে না-পারায় আমরা বেশ সমস্যায় পড়ি।”
গঙ্গা ঘেঁষা শ্রীরামপুরের চাতরা কুমোরপাড়াতেও বহু বছর ধরে চলছে প্রতিমা গড়ার কাজ। হুগলি ছাড়াও হাওড়া, এমনকী উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন জায়গাতেও পাড়ি দেয় এখানকার প্রতিমা।
এ বার প্রতিমা গড়ার সরঞ্জামের দাম শিল্পীদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। বর্ষীয়ান মৃৎশিল্পী স্বপন পাল জানান, বাঁশ, খড় থেকে মাটি সব কিছুরই দাম বেড়েছে। শোলার সাজের দামও বেড়েছে অনেকটাই। শিল্পীদের কথায়, গত বার তাঁরা যেখানে শোলার সাজ কিনেছিলেন ৭-৮ হাজার টাকায়, এ বার তার দাম পড়েছে প্রায় ১২ হাজার টাকা। সমস্যা রয়েছে শ্রমিক নিয়েও। নদিয়া, বর্ধমান, হুগলির বিভিন্ন গ্রাম থেকে এখানে শ্রমিক আসেন। ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পের জন্য পর্যাপ্ত শ্রমিক মেলেনি বলে মনে করছেন শিল্পীরা। এই কারণে সাধারণ সাজের দামও বেড়েছে। কেননা, কৃষ্ণনগর, বর্ধমানের বনকাপাসি, কালনা, নবদ্বীপ, ব্যান্ডেলের মতো যে সব জায়গা থেকে এই সাজ আসে, ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পের কারণে সেই সাজের আমদানি এ বার বেশ কম।
হিসেব কষে মৃৎশিল্পী কার্তিক পাল বললেন, “গত বছরের তুলনায় ঠাকুর গড়ার খরচ অন্তত ২০ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু খরচের অনুপাতে উদ্যোক্তাদের থেকে টাকা বাড়াতে পারলাম কই! তার উপর অনেক সময়েই কারও কারও কাছে কিছু টাকা বাকি থেকে যায়। লাভের গুড় পিঁপড়ে খায়।” “প্রশাসন যদি এই শিল্পের দেখভালে একটু নজর দেয়, তা হলে ভাল হয়”, অভিমত কার্তিকবাবুর। |