আক্রোশে চৈতালি খুন, পড়শি-সহ ধৃত ৪ |
পার্সেলে মোবাইল, ফোন করেই বিস্ফোরণ |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
মোটরবাইকে চড়ে দু’টি যুবক এক মহিলার বাড়িতে গিয়ে তাঁর হাতে একটি পার্সেল তুলে দিল। পার্সেলের ভিতরে অন্য জিনিসের সঙ্গে ছিল একটি মোবাইল ফোনও। যুবক দু’টি মোটরবাইকে চড়ে ফিরে যাওয়ার কয়েক মিনিট পরেই কেউ ফোন করল সেই মোবাইলের নম্বরে। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হল মহিলার। গুরুতর জখম হলেন তাঁর স্বামী।
হাওড়ার দক্ষিণ বাকসাড়ার বাড়িতে পার্সেলবোমা পাঠিয়ে চৈতালি সাঁতরা নামে এক মহিলাকে হত্যা করা হয় এ ভাবেই। ওই হত্যাকাণ্ডে মূল অভিযুক্ত এবং তার তিন সঙ্গীকে গ্রেফতার করে এই রহস্য ভেদ করেছেন গোয়েন্দারা। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ, পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ আর মোবাইলের সূত্র ধরেই বাকসাড়ার পার্সেলবোমা বিস্ফোরণের কিনারা করেছে হাওড়া সিটি পুলিশ।
বুধবার রাতেই ওই ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত সন্দেহে লিলুয়ার বাসিন্দা অভিষেক রায়, বিশ্বজিৎ মাজি ও শুভঙ্কর দাস নামে তিন যুবককে আটক করেন গোয়েন্দারা। জিজ্ঞাসাবাদের পরে গভীর রাতে তিন জনকেই গ্রেফতার করা হয়। বৃহস্পতিবার ভোরে রত্নগিরি থেকে মহারাষ্ট্র পুলিশের সাহায্যে সিটি পুলিশের গোয়েন্দারা নিহত চৈতালিদেবীর এক পড়শি যুবককে গ্রেফতার করেন। দেবাশিস দে নামে ওই যুবকই চৈতালি-হত্যার মূল চক্রী বলে জানান তাঁরা। দেবাশিস পেশায় ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। পুলিশ তদন্তে জেনেছে, ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকেই চৈতালিদেবীকে খুন করা হয়েছে। গত ২৬ সেপ্টেম্বর দক্ষিণ বাকসাড়ায় নিজের দোতলা বাড়ির একতলার শোয়ার ঘরে পার্সেলবোমা বিস্ফোরণে চৈতালিদেবী ঘটনাস্থলেই মারা যান। গুরুতর আহত হন তাঁর স্বামী হিমাংশু সাঁতরা। ঘটনার সময় ওই দম্পতির মেয়ে শতাব্দী বাড়িতে না-থাকায় বেঁচে যান। সিটি পুলিশ ছাড়াও ওই ঘটনার তদন্তে নামেন কেন্দ্র ও রাজ্যের ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ এবং সিআইডি। |
হাওড়ার পুলিশ কমিশনার অজেয় রানাডে বৃহস্পতিবার সাংবাদিক বৈঠকে জানান, দেবাশিসই ওই বিস্ফোরণ ও হত্যাকাণ্ডের মূল চক্রান্তকারী। বধূ-নির্যাতনের মামলায় জেলে থাকার সময়েই চৈতালিদেবীকে খুন করার জন্য শুভঙ্করের সঙ্গে বসে ছক কষে ছিল সে। খুনের জন্য ‘সুপারি’ হিসেবে শুভঙ্করকে দু’লক্ষ টাকা দিয়েছিল দেবাশিস। জেলে থেকে বেরিয়ে শুভঙ্কর পার্সেলবোমা বানাতে বলে লিলুয়ার বাসিন্দা বিশ্বজিৎকে। পার্সেলবোমাটি চৈতালির বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিল শুভঙ্কর ও অভিষেক। চার জনের বিরুদ্ধেই খুনের অভিযোগ আনা হয়েছে। এই ঘটনায় আরও দু’তিন জনকে খোঁজা হচ্ছে।
বিশ্বজিৎ পার্সেলবোমা বানাল কী ভাবে?
পুলিশ কমিশনার জানান, বিশ্বজিৎ ইলেকট্রিক মিস্ত্রি। তবে সে কী ভাবে ওই বোমার মালমশলা জোগাড় করল এবং বোমা বানাল, তা পরিষ্কার নয়। রানাডে বলেন, “বোমাটি বানানো হয়েছিল সাধারণ বোমা তৈরির মশলা দিয়ে। কিন্তু একটা কন্টেনারে অনেক বোমার মশলা দেওয়ায় বিস্ফোরণের তীব্রতা বেড়ে গিয়েছিল।” তদন্তে জানা গিয়েছে, শুভঙ্কর-অভিষেকই মোটরবাইকে চড়ে গিয়ে পার্সেলটি চৈতালিদেবীর হাতে দিয়ে ফিরে যায়। তার দু’-এক মিনিটের মধ্যেই বিস্ফোরণ ঘটে। পুলিশ কমিশনার জানান, বোমাটি বানানো হয়েছিল অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট, অ্যালুমিনিয়াম পাউডার এবং সালফার দিয়ে। ছিল ১০-১২টি ন’ভোল্টের ব্যাটারিও। বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিল মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। মোবাইলটা রাখা ছিল পার্সেলের মধ্যে। সেই মোবাইলে একটি ফোন আসার পরেই বিস্ফোরণ ঘটে। পুলিশ জানায়, জেরায় বিশ্বজিৎ স্বীকার করেছে, সে-ই ফোন করে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল।
কী ভাবে এই হত্যাকাণ্ডের কিনারা করল পুলিশ?
সিটি পুলিশ সূত্রের খবর, তদন্তে নেমেই জানা যায়, বধূ-নির্যাতনের অভিযোগে চৈতালিদেবীর পড়শি দেবাশিসকে গত বছর দুর্গাষষ্ঠীতে গ্রেফতার করা হয়েছিল। আদালতের নির্দেশে ১৪ দিন জেল-হাজতে থাকতে হয়তাকে। চৈতালিদেবী দেবাশিসের স্ত্রীর পক্ষে দাঁড়িয়ে তাঁকে নানা ভাবে সাহায্য করেছিলেন। জামিনে ছাড়া পাওয়ার পরে ওই যুবক পাড়ায় ফিরে আসে। এলাকার ক্ষিপ্ত জনতা মা, দিদি-সহ দেবাশিসকে মারধর করে বাড়িছাড়া করে। গোটা ঘটনায় চৈতালিদেবী প্রত্যক্ষ ভাবে যুক্ত ছিলেন বলে জানায় পুলিশ। তাই ওই মহিলার বিরুদ্ধে তীবির বিদ্বেষ জন্মায় দেবাশিসের। শুভঙ্কর মাস তিনেক আগে চৈতালিদেবীর বাড়ি গিয়ে দেবাশিসের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দেয়। চৈতালিদেবী রাজি হননি। মাসখানেক আগে তাঁকে সরাসরি খুনের হুমকি দেওয়া হয়।
এই সব তথ্য পেয়ে গোয়েন্দারা দেবাশিস সম্পর্কে খোঁজ নেন। দেবাশিস চাকরি সূত্রে আগে বিশাখাপত্তনমে ছিল। ইদানীং সে পুণেতে থাকে বলে জানতে পারে পুলিশ। হাওড়া জেলে দেবাশিসের সেলে ছিল শুভঙ্কর। তাকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল বধূ-নির্যাতন মামলায়। তার মোবাইল নম্বর জোগাড় করে তার সম্পর্কে খোঁজখবর নেন গোয়েন্দারা। দেবাশিসের মোবাইলের কললিস্ট পরীক্ষা করে দেখা যায়, গত কয়েক মাসে বিশাখাপত্তনম থেকে দেবাশিস বহু বার ফোনে শুভঙ্কের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। ২৬ সেপ্টেম্বর বিস্ফোরণের আগেও করেছে, পরেও করেছে। তাই শুভঙ্করকে আটক করে জেরা শুরু করেন গোয়েন্দারা। পুলিশের দাবি, জেরায় ভেঙে পড়ে সব কবুল করে শুভঙ্কর। তার পরেই তাকে এবং অভিষেক ও বিশ্বজিৎকে গ্রেফতার করা হয়। ধৃতদের এ দিন তোলা হয় হাওড়া আদালতে। অভিষেককে ১৪ দিন জেল-হাজতে এবং বিশ্বজিৎ-শুভঙ্করকে ১৪ দিন পুলিশি হাজতে রাখার নির্দেশ দেন বিচারক। |