নজরদারি বাড়াচ্ছে কেন্দ্র
চোরাচালানে স্বর্ণ-যুগ, আবার সে এসেছে ফিরিয়া
ক গা সোনার গয়না অনেকেই দেখেছেন। কিন্তু এক হাঁটু সোনা?
নিজের হাঁটুতে সাড়ে তিন কিলো সোনার চেন জড়িয়ে কলকাতা বিমানবন্দরে এসে নেমেছিলেন আব্দুল সালাম চামুন্ডি! যাবতীয় খানা-তল্লাশিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সেই দোহা থেকে এ ভাবেই নিয়ে আসছিলেন এক কোটি টাকার চোরাই সোনা। শেষ অবধি কলকাতা বিমানবন্দরে সোনার হাঁটু ধরে ফেলেন শুল্ক দফতরের গোয়েন্দারা।
ধরে ফেলতে পারেন, কারণ দেশের সব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেই এখন প্রভূত বাড়তি সতর্কতা। দরকারে শরীর তল্লাশিও। বিশেষ নজর দুবাই, হংকং, সিঙ্গাপুর কিংবা কাতার থেকে আসা যাত্রীদের দিকে। কারণ অর্থ মন্ত্রকের তথ্যই বলছে, মাত্র এক বছরের মধ্যে এক লাফে দশ গুণ বেড়ে গিয়েছে বিদেশ থেকে বেআইনি সোনার আনার ঘটনা।
হঠাৎই যেন ফিরে এসেছে সত্তর-আশির দশক। সেই সময়, যখন ‘দিওয়ার’ থেকে ‘ডন’ বক্স অফিস তোলপাড় করা সিনেমার খলনায়ক মানেই সোনা চোরাচালানকারী। যখন বাস্তবেও মুম্বইয়ের (তখন বোম্বে) মাটি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হাজি মস্তানরা। পুলিশের চোখ এড়িয়ে বিদেশ থেকে সোনা আনার ব্যবসা চলছে রমরমিয়ে।
সেই স্মৃতিই উস্কে দিয়ে এ বছর শুধু এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যেই দেশের বিভিন্ন বিমানবন্দরে আটক হয়েছে প্রায় ৯৪০ কোটি টাকার সোনা। মামলা হয়েছে ২০০টি। যেখানে ২০১১ সালের এপ্রিল-জুনে এমন মামলার সংখ্যা ছিল মাত্র ২০। আটক হয়েছিল ২৪০ কোটির সোনা।
কেন এমন ঘটছে? ‘ডন’দের মস্তানি ছেঁটে সোনা চোরাচালান কমিয়ে ফেলার জন্য তো নব্বইয়ের গোড়ায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহকেই অনেকখানি কৃতিত্ব দিয়েছিল গয়না শিল্প। বাজার খোলার পথে হেঁটে দেশে সোনা আমদানির পথ সুগম করেছিলেন তিনি। তা হলে সেই মনমোহনেরই প্রধানমন্ত্রিত্বে চোরাচালানের ‘সোনার দিন’ ফিরে এল কী ভাবে? তা-ও আবার এমন সময়ে, যখন প্রায় টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের গতিতে সংস্কারের দ্বিতীয় ইনিংস খেলছেন তিনি?
বিশেষজ্ঞদের মতে, এর কারণ মূলত দু’টি (১) বিদেশ থেকে সোনা আনতে দাম গুনতে হয় ডলারে। যত ডলার বাইরে যাবে, টাকার দাম পড়বে তত বেশি। যা আখেরে বাড়িয়ে দেবে ঘাটতি। এই যুক্তি মাথায় রেখেই গত বাজেটে সোনা আমদানিতে রাশ টানতে চেয়েছিল কেন্দ্র। আর তাই গত বাজেটে সোনার উপর আমদানি শুল্ক এক বারে দ্বিগুণ (সোনার পাতে ২% বাড়িয়ে ৪%, গয়নায় ৫% থেকে ১০%) করে দিয়েছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। অনেকেই মনে করছেন, এই বাড়তি কর এড়াতেই বেআইনি পথে সোনা আনছেন কারবারিরা। যেমন ধরা পড়ার পর আব্দুলই স্বীকার করেছিল, মুম্বইয়ের ব্যবসায়ীর হাতে ওই সোনা তুলে দেওয়ার কথা ছিল তার।
(২) দেশে সোনার দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। তাই সেই বাজারে দু’পয়সা করে নেওয়ার পথ খুঁজতেও বাঁকা পথে সোনা আনছেন অনেকে।
কিন্তু এই আগুন বাজারে সোনার এত চাহিদা কেন? বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, একটু বেশি ‘রিটার্ন’ চাইলে মানুষ সাধারণত টাকা খাটান তিন জায়গায়। শেয়ার বাজার, ডলার আর সোনা। শেয়ার বাজার এখন মোটামুটি চাঙ্গা। কিন্তু কত দিন চড়া থাকবে, তা অনিশ্চিত। মার্কিন অর্থনীতির দশা বেহাল হওয়ায় তেমন ভরসা জোগাচ্ছে না ডলার। এই পরিস্থিতিতে টাকা ঢালার নির্ভরযোগ্য জায়গা হিসেবে কদর বাড়ছে সোনার। বিশেষত বিভিন্ন ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের স্বর্ণমুদ্রার। সব মিলিয়ে বাড়ছে সোনার চাহিদা। শুল্ক ফাঁকি দিতে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে চোরা পথে সোনার আমদানিও।
এতটাই যে, শুধু পেশাদার ‘ক্যারিয়ার’ নয়। শুল্ক দফতরের নজর এড়াতে গয়না পরে বা শরীরে লুকিয়ে বাইরে থেকে সোনা আনছেন অনেক ধনী পরিবারের সদস্যরাও। যেমন কিছু দিন আগেই জয়পুরে মোজার মধ্যে আড়াই কিলো সোনা নিয়ে ধরা পড়েছেন এক জন। জেরায় স্বীকার করেছেন, কয়েক মাসের মধ্যে কুড়ি বারেরও বেশি লুকিয়ে সোনা এনেছেন তিনি।
এমনিতে বিদেশ থেকে সোনা আনার ব্যাপারে নিয়মটা কী? যে সব ভারতীয় বিদেশে এক বছরের বেশি সময় কাটিয়ে আসছেন, তাঁদের মধ্যে পুরুষরা সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা ও মহিলারা সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা মূল্যের গয়না গায়ে পরে আসতে পারেন। এই মূল্যের গয়নায় কোনও শুল্ক লাগে না। এর থেকে বেশি পরিমাণ সোনা আনাতে হলে শুল্ক দিতে হবে। ছ’মাস কাটিয়ে যাঁরা আসছেন, তাঁরা শুল্ক মিটিয়ে সর্বোচ্চ ১০ কিলোগ্রাম সোনা বিদেশ থেকে আনতে পারেন। এ বাদে বাইরে বেড়াতে গিয়ে সোনার গয়না কিনলে শুল্ক ছাড়ের পরিমাণ সংশ্লিষ্ট পর্যটক কোন দেশ থেকে আসছেন, তার উপর নির্ভর করে। নেপাল, ভুটান, মায়ানমার ও চিনের ক্ষেত্রে ছাড়ের মাত্রা যেমন কম। এ দেশে বসে অনলাইন-এ বিদেশ থেকে গয়না কেনার ক্ষেত্রে অবশ্য সমস্যা নেই। শুল্ক দফতর জানাচ্ছে, কেউ যদি না জেনে ছাড়ের মাত্রার বাইরে গয়না কিনে ফেলেন, তা হলে সাধারণত শুল্ক ও জরিমানা নিয়েই তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু শুল্ক কর্তাদের যদি সন্দেহ হয় যে, বিষয়টি অনিচ্ছাকৃত ভুল নয়, তা হলে সেই সোনা আটক করা হয়। ইদানীং শুল্ক ফাঁকি দিয়ে সোনা আনার হিড়িক বাড়ছে, এটাই কেন্দ্রের উদ্বেগের বিষয়।
পরিস্থিতি সামাল দিতে উদ্যোগী হয়েছেন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম। এক দিকে যেমন চোরাচালান রুখতে গোয়েন্দাদের সজাগ করা হচ্ছে, অন্য দিকে সোনার চাহিদা কমানোর দাওয়াই খুঁজতে ঘন ঘন বৈঠকে বসছেন অর্থমন্ত্রী। চেষ্টা করছেন, সোনার চাহিদা ফিকে করতে জীবন বিমা বা মিউচুয়াল ফান্ডে টাকা রাখার আকর্ষণ বাড়াতে। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা সি রঙ্গরাজনও মনে করেন, “দ্রুত লগ্নির বাজারে আনতে হবে সোনার মতোই আকর্ষণীয় কোনও পণ্য।” ভারতের মতো দেশে কাজটা যে কত কঠিন, তা বিলক্ষণ জানেন তাঁরা। কারণ, সোনার চাহিদায় সারা পৃথিবীতে একেবারে প্রথম সারিতে ভারত।
তবু জান কবুল করছে কেন্দ্র। না হলে তো দেশ ছেয়ে যাবে ‘জঞ্জির’-এর সংলাপে “মোনা, লুট লো সোনা!”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.