মহালয়ার ভোরে রেডিওতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মন্দ্রকণ্ঠ ভেসে না এলে যেন আসতেই চায় না পুজোর আমেজ। এ যেন অনেকটা সন্ধ্যাবেলায় প্রদীপ জ্বলার আগে সলতে পাকানো। সেই সঙ্গে মনের আয়নায় ভেসে ওঠে কিছু মুহূর্ত। গঙ্গায় তর্পণ, তর্পণ শেষে ফিরে জিলিপি খাওয়া, পুজোর দিনগুলোয় জমিয়ে আড্ডা মারা আরও কত। এ সবের ফাঁকেই চোখে পড়ে, ফিরে এসেছে ব্যস্ততার সেই চিরপরিচিত ছবি। দুই পাড়ার একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার লড়াই। আর বাস-ট্রাম-মেট্রো সর্বত্র ‘আচ্ছা দাদা, এ বার সপ্তমীটা কী বার পড়েছে বলতে পারেন’, বা ‘টালা বারোয়ারির এ বারের থিম কী বলুন তো মশাই? শুনছি নাকি ঝুলন্ত পুজো হবে?’ গোছের মন্তব্য।
এ সব টুকরো ছবি নিয়েই ডালি সাজায় কলকাতার একান্ত নিজস্ব দুর্গাপুজো। বিষয়-ভাবনায়-আঙ্গিকে পুরনোর মধ্যেই নতুনকে খোঁজার চেষ্টা তার। সেই পথের পথিক শোভাবাজার সর্বজনীন। পুরাণে আছে, সমুদ্রমন্থনে যে বিষ উঠেছিল, তা থেকে এক দিকে অসুর, অন্য দিকে মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন দেবতা। কিন্তু কী সেই মানুষের পরিচয়? তাঁর বিনাশই বা কখন? এই সব প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে যেতে হবে এই পুজোর মণ্ডপে। কারণ, ঠিকুজির মাধ্যমে সেখানে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে মানুষের আত্মপরিচয়ের দিনলিপি।
সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে ভারতের মহাকাব্যের সমাদর দেশে-বিদেশে। অশুভকে হারিয়ে শুভ চেতনার বিকাশ বার বার উঠে এসেছে এই সব মহাকাব্যে। সেই জয়গাথার প্রতিফলন আহিরীটোলা সর্বজনীনের পুজোর ভাবনাতেও। কালিদাসের কুমারসম্ভবকে ফিরিয়ে আনবেন তাঁরা। ইতিহাসের পথ ধরে দর্শক পৌঁছে যাবেন স্বর্গলোকে, এমনই দাবি উদ্যোক্তাদের।
বর্তমানের থিম পুজোর রমরমার যুগে হারিয়েই যেতে বসেছে ভিন্ রাজ্যের প্রত্যন্ত গ্রামের লোকশিল্প। এমনই একটি লোকশিল্প মধুবনী জেলার দুসার অঞ্চলের গোধনা। মাটির পুতুল, গৃহসজ্জার ড্রাই ফ্লাওয়ার-এর সঙ্গে এই লোকশিল্পের রঙিন প্রকাশ এ বার দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিট পল্লি সমিতির পুজোমণ্ডপে। তাঁদের বিষয়-ভাবনা ‘আদি অন্ত’। লোকশিল্পের পাশাপাশি থাকবে ভারতীয় সভ্যতার নানা পর্যায়ের বিবরণ। হিন্দু ধর্মের যে প্রধান তিন দেবতা ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর, তাঁদের মধ্যে থেকে সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সকলের পূজিত হয়ে উঠলেন অনার্য শিব। এই পুজো সন্ধান দেবে না-জানা এমনই অনেক কাহিনির।
মালোপাড়া সর্বজনীনের পুজোয় এ বার অন্য এক ছবি। ‘পুতুল মেলা’। প্রত্যন্ত এক গ্রামের কারিগর কী ভাবে নিপুণ দক্ষতায় তৈরি করেন এমন একটি মনজয়ী জিনিস, এই পুজো তা-ই তুলে ধরবে। মণ্ডপের ভিতরে দেখা যাবে, এক জন বিক্রেতা নিজের হাতে গড়া পুতুল মেলায় ফেরি করে চলেছেন। দেবী দুর্গারও পুতুল-রূপ। জৌলুস বাড়াবে মুখোশের রঙিন সাজ।
দেখতে দেখতে হাটখোলা গোঁসাইপাড়া সর্বজনীন পেরিয়ে এল ৭৪ বছর। দুর্গাপুজোর সাবেকিয়ানা বজায় রাখাতেই এঁদের আনন্দ। সেই ঐতিহ্য বজায় রেখে শিল্পী স্বপন পাল সাবেক সাজে সাজাবেন ত্রিনয়নীকে। তাঁর ভুবনমোহিনী রূপে দূর হবে সব অহংকার, দেখা দেবে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। সম্প্রীতির বাঁধনে বাঁধা পড়বে জগৎ-সংসার।
শারদোৎসব এখন আর শুধু বাংলার নয়। তার রেশ আজ পৌঁছে গিয়েছে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারেও। এই উৎসবে এ বার নতুন মাত্রা যোগ করতে প্রয়াসী বেনিয়াটোলা সর্বজনীন। ত্রিপুরার চাটাই, খড়ের উপরে মাদুরের কাজে সেজে উঠবে তাঁদের মণ্ডপ। মূল প্রবেশপথের দু’পাশে খেটে খাওয়া মানুষের রোজনামচা। সঙ্গে বাড়তি পাওনা সাবেক প্রতিমা।
কলকাতার পুজো-মানচিত্রে বরাবরই স্বতন্ত্র ধারায় হাঁটতে চেয়েছে কুমোরটুলি পার্ক সর্বজনীন। ২০তম বর্ষে শিল্পী দেবাশিস বসু এই পুজোয় মেলাবেন দুই রাজ্যের শিল্প-সংস্কৃতিকে। মণ্ডপে ঢোকার পথে দু’পাশে দেখা যাবে এলইডি আলোর বিচ্ছুরণ। থিমের সঙ্গে মানানসই প্রতিমা।
এখনকার শহুরে জীবন থেকে হারিয়েই গিয়েছে রঙিন প্রজাপতি। প্রজাপতির হরেক রং যেন প্রকৃতির নানা রঙের রূপক। রামমোহন স্মৃতি সঙ্ঘ প্রজাপতির স্বপ্নের মাধ্যমে তুলে আনবে একটুকরো সবুজায়ন। প্রজাপতি যেমন নানা রঙে জগতের শোভা বাড়ায়, তেমন সবুজায়নের মধ্যে দিয়েও নতুন রূপ পাবে প্রকৃতি।
এই সব ছবির কোলাজেই পূর্ণতা পাবে শারদোৎসব। ‘সপ্তলোক তাই আনন্দমগ্না’। |