নিমতলা শ্মশান ঘাটে গঙ্গার অন্তত পঞ্চাশ ফুট ভিতর পর্যন্ত থাম গেঁথে একটি চাতাল তৈরি করবে কলকাতা পুরসভা। কিন্তু হেরিটেজ কমিটির আপত্তিতে পুরসভার সেই উদ্যোগ আপাতত থমকে গিয়েছে।
নিমতলা শ্মশান ঘাটের উন্নয়ন, পরিবর্ধন এবং সেখানকার রবীন্দ্র স্মৃতি উদ্যানের উন্নয়নে পুরসভা ২০১০ সালের মার্চ মাসে হেরিটেজ কমিটির কাছে দু’টি প্রস্তাব পেশ করে। পরে পুরসভা নিয়োজিত হেরিটেজ কমিটির বৈঠকেও ওই বিষয়ে প্রস্তাব পেশ করা হয়। প্রস্তাবগুলি ছিল: রবীন্দ্র স্মৃতি উদ্যান এবং প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের স্মৃতিবিজড়িত অংশের পরিবর্ধন ও সৌন্দর্যায়ন ঘটানো হবে। দূষণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা-সহ আরও আটটি বৈদ্যুতিক চুল্লি বসানো হবে। তার জন্য নতুন ভবন তৈরিরও প্রস্তাব করা হয়। তবে ভবনটি দেখতে যাতে কারখানা বা গুদামের মতো না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। শ্মশানের হেরিটেজ অংশের সংরক্ষণের পরিকল্পনাও করা হয়। গোটা কাজের জন্য খরচ ধরা হয় প্রায় ১২ কোটি ৯৬ লক্ষ টাকা। হেরিটেজ কমিটির ওই প্রস্তাব ২০১১-এর ৪ নভেম্বর পুরসভার মেয়র পরিষদের বৈঠকে অনুমোদন পায়।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর ফের নবগঠিত হেরিটেজ কমিটির বৈঠকে ওই অনুমোদিত প্রস্তাব পেশ করা হয়। পুরসভার পক্ষ থেকে তাদের জানানো হয়, প্রস্তাবিত ওই নির্মাণের সঙ্গে গঙ্গার ভিতরে থাম গেঁথে চাতালও তৈরি হবে। ঠিক কী হবে নিমতলা ঘাটে? মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষ জানান, রবীন্দ্র স্মৃতি উদ্যানের মুখোমুখি কাঠের চুল্লি সরিয়ে আরও দক্ষিণে নিয়ে যাওয়া হবে। রবীন্দ্র স্মৃতি উদ্যানকে আরও বড় করা হবে। নতুন করে কাঠের চুল্লি, শবযাত্রীদের বিশ্রামের ব্যবস্থা ইত্যাদি করতে গঙ্গার প্রায় ৫০ ফুট ভিতর পর্যন্ত থাম গেঁথে প্ল্যাটফর্ম তৈরি হবে। অতীনবাবুর কথায়, “নিমতলা শ্মশান আরও প্রশস্ত করতে এবং শবযাত্রীদের সুবিধায় এই পরিকল্পনা করা হয়েছে।” একটি ঠিকাদার সংস্থা প্রাথমিক কাজ শুরুও করেছিল। কিন্তু টেন্ডারের খুঁটিনাটিতে তা সাময়িক ভাবে আটকে গিয়েছে বলে জানান অতীনবাবু।
নিমতলা ঘাটের এই প্রকল্পে টাকা দিচ্ছেন জাতীয় গঙ্গা অববাহিকা কর্তৃপক্ষ। অথচ গঙ্গার দূষণ নিয়ন্ত্রণের কোনও ব্যবস্থা ওই প্রকল্পে নেই। হেরিটেজ কমিটির সদস্যেরা এই প্রকল্পের বিরোধিতা করায় সেটি আপাতত আটকে গিয়েছে। নিমতলা ঘাট প্রথম শ্রেণির হেরিটেজ হিসেবে তালিকাভুক্ত হওয়ায় সেখানে যে কোনও নির্মাণের জন্য হেরিটেজ কমিটির অনুমোদন এবং ছাড়পত্র আবশ্যিক। হেরিটেজ কমিটির সদস্য এবং নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র বলেন, “গঙ্গার স্রোত ব্যাহত করে এমন নির্মাণ নদীর ভয়ানক ক্ষতি করবে। জোয়ার-ভাটা খুবই জোরালো ভাবে খেলে গঙ্গার এই অংশে। গঙ্গার ভিতরে বাধা তৈরি করলে সেখানে পলি এবং অন্যান্য জঞ্জাল জমে নদীর বুক উঁচু হতে থাকবে। এটা হতে দেওয়া যায় না।”
তা ছাড়া বহতা নদীর স্রোত আটকে কোনও রকম নির্মাণ নিষেধ করে একটি আইনও রয়েছে। ১৯৭৪ সালের সেই জল (দূষণ ও নিয়ন্ত্রণ) আইনে বলা আছে, বহতা নদীর স্রোত বাধা সৃষ্টি করে এমন নির্মাণ বা অন্য কিছু তৈরি করা যাবে না। এ কথা জানিয়ে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত আইন আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, “ভদ্রেশ্বর পুরসভা এক বার গঙ্গার মধ্যে থাম গেঁথে নির্মাণ শুরু করেছিল। কিন্তু হাইকোর্ট নিয়োজিত কমিটি ওই আইনের বলে তা ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। পর্ষদের তত্ত্বাবধানে সেটি ভেঙে দেওয়া হয়। কলকাতায় কয়েকটি পরিত্যক্ত জেটি এবং গঙ্গায় পড়ে থাকা পুরনো জাহাজও হাইকোর্টের অনুমতি সাপেক্ষে কমিটির নির্দেশে সরিয়ে ফেলা হয়।” কিন্তু জনস্বার্থে কোনও সেতু বা জেটি তৈরির আগে পরিবেশ দফতরের ছাড়পত্র নিতে হয়।
শুধু নিমতলা ঘাটেই নয়, আর্মেনিয়ান ঘাটের কাছেও গঙ্গার ভিতরে ওই ধরনের চাতাল তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুরসভা। এর আগে বাবুঘাটের কাছে গঙ্গার ভিতরে চাতাল তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রাজ্য পর্যটন দফতর। সেনাবাহিনীর ছাড়পত্র না পাওয়ায় সেটি আটকে যায়। এখন তা বটানিক্যাল গার্ডেনের কাছে তৈরি করার পরিকল্পনা করেছে রাজ্য। |