মোচড়ানো গোঁফ, হাতে লম্বা লাঠি, দশাসই চেহারার পাহারাওয়ালাকে দেখে তাঁর মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখত বিছানায় শোয়া অসুস্থ অমল। এ ভাবেই মনে মনে সে-ও কখন যেন হোমরা-চোমরা পাহারাওয়ালা হয়ে দাপিয়ে বেড়াত।
‘ডাকঘর’-এর অমলের ইচ্ছাপূরণের আগেই নেমেছিল অন্ধকার। কিন্তু ২০১২ সালে তার মতো আর এক ছোট্ট ছেলের ইচ্ছেগুলো অন্তত অসুখের বিছানায় ডুবে যায়নি। ঠাকুরপুকুর ক্যানসার হাসপাতালে ধুঁকতে ধুঁকতে, হাতে স্যালাইন লাগিয়ে পুলিশ হওয়ার স্বপ্ন দেখত সাত বছরের সুরজ। বৃহস্পতিবার সেই ইচ্ছেয় ভর করে ‘এক দিনের দারোগা’ হয়ে সে দাপিয়ে বেড়াবে নিউ টাউন থানায়। আর পুলিশবাহিনী পাবে সম্ভবত তাদের সর্বকনিষ্ঠ ইনস্পেক্টরটিকে।
স্টেজ-থ্রি ক্যানসারে আক্রান্ত ছোট্ট সুরজ বিনবংশীর ইচ্ছাপূরণে বিধাননগর কমিশনারেটের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল একটি আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। সানন্দে তাদের পুঁচকে দারোগাকে স্বাগত জানিয়েছে পুলিশবাহিনী। তার জন্য নিউ টাউন থানায় রাখা হয়েছে আলাদা চেয়ার-টেবিল। থানার কর্মীরাও প্রস্তুত।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ‘স্যর’ ঢুকলেই অ্যাটেনশন হয়ে ঝড়াৎ করে সেলাম ঠুকবেন সবাই মিলে। |
আর খুদে ‘স্যর’টি কী করবে? বাঁ হাতে স্যালাইন চলছে। ডান হাতে নতুন কেনা পুলিশের পোশাক গলিয়ে, এক চোখ বুজে মন দিয়ে খেলনা বন্দুকে টিপ প্র্যাকটিস করছিল সে। রীতিমতো দাপটের সঙ্গে বলল “সব চোর কো অউর মোটা-মোটা ডাকুকো ঢাঁই ঢাঁই ঢাঁই ঢাঁই মার দেঙ্গে।” তার পরে গলা নামিয়ে আফশোসের সুরেই হাতের বন্দুক দেখিয়ে ইনস্পেক্টর সাহেবের বক্তব্য, “ইয়ে বন্দুক ছোটা হ্যায়। চোর নেহি মরেঙ্গে। থানা যাকে বড়া বন্দুক লেঙ্গে।”
হুগলির চাঁপদানির এনডি লাইন কলোনির ছোট্ট ঘরে মা সুনীতা দেবী, বাবা জিতেন্দ্র বিনবংশী এবং আরও তিন ভাইবোনের সঙ্গে থাকে সুরজ। দু’বছর বয়সে তলপেটে একটা বড়সড় পটলের আকারের টিউমার ধরা পড়ে। আসল রোগটা ধরা পড়েছে মাত্র তিন মাস আগে। ক্যানসার তত দিনে শরীরে অনেকটাই ছড়িয়ে গিয়েছে।
ঠাকুরপুকুরের হাসপাতালে গত ১১ অগস্ট থেকে ভর্তি সুরজের প্রথম দফার কেমোথেরাপি সবে শেষ হয়েছে। সুরজের চিকিৎসক সোমা দে বলেন, “আমরা সবাই মনেপ্রাণে চাই একটা মির্যাক্ল হোক।” তাঁর কথায়, “এর আগে আমাদের হাসপাতালের আরও কিছু বাচ্চার ইচ্ছাপূরণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু তারা সবাই খেলনাপাতি চেয়েছে। সুরজের ইচ্ছেটা অবশ্য একেবারেই অন্য রকম, সত্যিকারের মনের কথা বলে মনে হয়েছে আমাদের।”
ক্যানসার আর ইচ্ছাপূরণের অনেক গল্প তো হিন্দি ছবিতেও মজুত। ‘আনন্দ’-এ ক্যানসার-আক্রান্ত নায়ক জানতেন তাঁর জীবনের মেয়াদ আর কিছু দিন। তাই নিজেই নিজের ইচ্ছপূরণে কসুর করতেন না। রাস্তাঘাটে যখন যাঁর সঙ্গে আলাপ করতে, গল্প করতে ইচ্ছা করত, করে ফেলতেন। যখন যা বলতে ইচ্ছা করত, বলতেন। সব সময়ে আনন্দে থাকার ইচ্ছেডানা লাগিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। আবার বিনয় পাঠক অভিনীত ‘দশবিদানিয়া’র নায়ক ছিলেন ছাপোষা অ্যাকাউন্ট্যান্ট, ভিতু, সাবধানী। ইচ্ছে করত অনেক কিছু, সাহস হত না। সেই লোকই যখন জানলেন ক্যানসারের জন্য আয়ু আর মাত্র কয়েক মাস, তখন নিজের ইচ্ছের একটা তালিকা করতে বসলেন। দশটা ইচ্ছে। একটা করে পূরণ করতেন আর তালিকায় টিক দিতেন।
কিন্তু এত কিছু থাকতে হঠাৎ সুরজের ইচ্ছে-তালিকায় পুলিশ কেন? মনোবিদ প্রথমা চৌধুরীর ব্যাখ্যা, “কিছু মানুষের মধ্যে এক ধরনের অ্যাচিভমেন্ট মোটিভেশন থাকে। এর ক্ষেত্রেও সুরজেরও তাই। সে মনে করছে, পুলিশ হলে অনেক ক্ষমতা পাওয়া যায়, অন্যকে ভয় পাওয়ানো যায়। ছোট্ট ছেলে বিশ্বাস করছে স্পাইডারম্যান, ব্যাটম্যান বা ছোটা ভীমের মতো শক্তিশালী পুলিশ, যে ইচ্ছে করলে অনেক ঢিসুম-ঢিসুম করে বদমাশদের ঢিট করে দিতে পারে। তাই তো সে পুলিশের ফ্যান।”
আবার মনোবিদ মোহিত রণদীপ বলেন, “ছোটবেলায় তিনটে জিনিস দেখিয়ে আমরা বাচ্চাদের ভয় পাওয়াই। ভূত, জুজু আর পুলিশ। ভূত আর জুজুকে চোখে দেখা যায় না। কিন্তু পুলিশ নামক জুজুকে দেখা যায়। সে যে ভয়ঙ্কর শক্তিশালী একটা প্রাণী, এ রকম একটা ধারণা শিশুমনে প্রথম থেকেই গেঁথে যায়। পুলিশ হলে কেউ শাসন করবে না, বকতে পারবে না, কেউ অন্যায় করলে তাকে শাস্তি দিতে পারব এমনই ভেবে নেয় শিশুরা।”
সে যা-ই হোক, নিউ টাউন থানা নতুন ইনস্পেক্টর নিয়ে উত্তেজিত। ‘তিনি’ কী খেতে ভালবাসেন, কী নিয়ে খেলাধুলো করবেন সব তথ্যই জোগাড় করা চলছে। কয়েক জন পুলিশকর্মীকে তৈরি রাখা হচ্ছে, যাঁরা ‘স্যর’কে খেলায় সঙ্গ দেবেন!
নিউ টাউন থানার দায়িত্বে থাকা গৌতম চক্রবর্তী বলেন, “চমকপ্রদ ব্যাপার। মারণ রোগের সঙ্গে লড়াই করছে, এমন একটি শিশুর ইচ্ছাপূরণ যদি করতে পারি, ক্ষতি কী? সর্বকনিষ্ঠ ইনস্পেক্টরকে অভ্যর্থনা জানানোর অপেক্ষায় রইলাম।” |