ডন টু ডাস্ক। সূর্য-ঘড়িতে সময়ের মাপ।
ব্রিটিশ আমলের তৈরি সেই সূর্যাস্ত আইন বেশ কিছু ক্ষেত্রে আজও বলবৎ রয়ে গিয়েছে। সূর্যাস্তের পরে ময়না-তদন্ত করেন না চিকিৎসকেরা। সন্ধে হওয়ার আগেই খাঁচায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় জেল-বন্দিদের। এত দিনে এই প্রথা ভাঙতে উদ্যোগী হচ্ছে রাজ্য কারা দফতর।
আইজি (কারা) রণবীর কুমার লিখিত প্রস্তাব পাঠিয়েছেন স্বরাষ্ট্র দফতরে। তাতে বলা হয়েছে, এখন সূর্য ডোবার আগেই বন্দিদের সেলে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। স্বাধীন রাষ্ট্রে এই ব্রিটিশ রীতির অবসান ঘটিয়ে সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের অন্তত রাত আটটা পর্যন্ত গরাদের বাইরে থাকার অনুমতি দেওয়া হোক।
আইজি (কারা)-র বক্তব্য, এক-দেড়শো বছর আগে এত বৈদ্যুতিন আলো ছিল না। সন্ধের পরে লন্ঠন হাতে জেলের পাহারায় থাকতেন কারারক্ষীরা। তাই নিরাপত্তার স্বার্থে আকাশে সূর্য থাকতে থাকতেই বন্দিদের অন্ধকার খুপরিতে ঢুকিয়ে দিত ব্রিটিশ শাসকেরা। এখন সেই সমস্যা নেই। নিরাপত্তার খাতিরে জ্যামার থেকে ক্লোজড সার্কিট টিভি, সমস্ত উপকরণই মজুত। তার পরেও কেন ওই প্রাচীন প্রথা আঁকড়ে থাকা, প্রশ্ন তুলেছে কারা প্রশাসন। আইজি (কারা)-র ব্যাখ্যা মেনে নিচ্ছেন স্বরাষ্ট্র দফতরের অফিসারেরাও। তাঁদের বক্তব্য, “ব্রিটিশ আমলে জেল ছিল কয়েদখানা। কিন্তু যে দিন থেকে জেল হয়েছে সংশোধনাগার, সে দিন থেকেই বহু কঠোর নিয়মের অবলুপ্তি ঘটেছে।” সেই পথেই গরাদের বাইরে থাকার মেয়াদও বাড়ানো উচিত বলে মনে করছেন তাঁরা।
একই ভাবে সূর্যাস্তের পরেও যে ময়না-তদন্ত হওয়া উচিত, সে কথাও এক বাক্যে মানছেন রাজ্য প্রশাসনের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, আগে দিনে রাতে পর্যাপ্ত আলোর অভাবে দিনের বেলায় অস্ত্রোপচার করতেন চিকিৎসকেরা। কিন্তু এখন রাতের বেলায় অনায়াসে জরুরি অস্ত্রোপচার হয়। আলোর কোনও অভাব হয় না। তা হলে শুধু ময়না-তদন্তের ক্ষেত্রে আলোর অভাব দায়ী হবে কেন? অর্থাৎ, এখানেও সেই ব্রিটিশ প্রথা রদের দাবি। যুক্তিও একই।
পুলিশ বলছে, প্রতি দিন গড়ে ৩০টি পরিবার তাঁর স্বজনের অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণ জানতে পারেন না। কারণ, সূর্যাস্তের পরে মৃতদেহ কাটাছেঁড়া করা যায় না। অনেক ক্ষেত্রে এমনও হয় যে, বেলা ১টার পরে কোনও মৃতদেহ এলেও তার ময়না-তদন্ত হয় না। সংশ্লিষ্ট পরিবারকে বলে দেওয়া হয়, মৃতদেহ মর্গে জমা করতে। রাজ্যের ডাইরেক্টর অফ হেলথ সার্ভিস বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “এটাই নিয়ম। সূর্য ডোবার পরে ময়না-তদন্ত হয় না। একান্তই জরুরি হলে প্রশাসনের বিশেষ অনুমতির প্রয়োজন হয়।”
পশ্চিমি দুনিয়া নিজে কিন্তু অনেক আগেই এই নিয়ম থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা বলছিলেন, “আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলিতে ময়না তদন্তের জন্য ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ২৪ ঘণ্টা ডাক্তার মজুত থাকেন। মর্গের অপারেশন থিয়েটারগুলি আলোয় ভরিয়ে দিয়ে দিন-রাতের তফাতটাই ঘুচিয়ে ফেলেছে ওরা।” এসএসকেএম হাসপাতালের ফরেন্সিক বিভাগের প্রাক্তন প্রধান অজয় গুপ্ত জানাচ্ছেন, শ্রীলঙ্কায় স্বাভাবিক মৃত্যুতেও ময়না-তদন্ত বাধ্যতামূলক। কারণ ওঁরা মনে করেন, যে কোনও মৃত্যুর কারণ জানতে ময়না-তদন্ত আবশ্যিক। এতে চিকিৎসকেরাই কেবল লাভবান হন তা নয়, সাধারণ মানুষও পরোক্ষে উপকৃত হন। ফলে ও দেশেও ২৪ ঘণ্টা ময়না-তদন্ত হয়। এখানে এখনও পর্যন্ত সব মহকুমা হাসপাতালে ময়না তদন্তের পরিকাঠামোই গড়ে তুলতে পারেনি রাজ্য সরকার। শুধু যে সব হাসপাতালের মর্গকে ‘পুলিশ মর্গ’ হিসেবে চিহ্নিত, সেখানেই ময়না তদন্তের ডাক্তার দেয় স্বাস্থ্য দফতর। মাত্র এক জন চিকিৎসকই থাকেন ময়না-তদন্তের দায়িত্বে। কোনও দিন তিনি গরহাজির হলে তার খেসারত দিতে হয় সাধারণ মানুষকে। সূর্যান্ত আইনের বদল হলে ভোগান্তির পরিমাণ অনেকটা কমানো যেতে পারে বলে আশা করছে প্রশাসন। |