প্রথমে আসছেন উমা। আর তার ঠিক পরেই ঈদুজ্জোহা। পিঠোপিঠি এই দুই উৎসবের আগে বাজারগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জমে উঠছে সীমান্তের হাটগুলোও। ডোমকলের গঞ্জগুলোতে কোথাও সপ্তাহে তিন দিন, দু’দিন কোথাও আবার একদিনের হাট বসে। আর এই দুই উৎসবের মুখে সেই হাটের দিনগুলোতে উপচে পড়ছে ক্রেতাদের ভিড়। রানিনগরের সেখপাড়া, গোধনপাড়া কিংবা জলঙ্গির পদ্মাঘেঁষা লালকূপের মত হাটগুলোতে সেই ভিড় সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। খোলা আকাশের নিচে তার্পোলিন বিছিয়ে চলছে দরদাম, বিকিকিনি।
বাজার জমে উঠেছে নয়, ওরা বলেন, বাজার লেগেছে। পুজো কিংবা ঈদের ঠিক আগে হাটে ক্রেতাদের ভিড় দেখলেই অভিজ্ঞ চোখ বুঝে নেয় যে বাজার এবার লাগতে শুরু করেছে। দীর্ঘ প্রায় চার দশক ধরে ডোমকলের কুপিলা হাটে পোশাকের দোকান দেন প্রৌঢ় আসমত আনসারি। আসমতের কথায়, “একটা সময় হাটই ছিল এলাকার মানুষের শেষ কথা। পেরেক থেকে পোশাক, সব্জি থেকে সরা কিংবা আলতা থেকে আতর সবকিছুই মিলত হাটেই। তবে সেই রমরমা আগের থেকে এখন অনেক কমে গিয়েছে। ফিকে হয়ে গিয়েছে হাটের সেই জৌলুসও। তবে এটা ঠিক গাঁয়ে গঞ্জে আজও কিছু নির্দিষ্ট ক্রেতা আছেন যাঁরা সারাটা বছর হাটের উপরেই ভরসা করেন। আর পরবের সময়গুলোর জন্য আমরাও তাকিয়ে থাকি কারণ এই সময়টাই বেচাকেনা বেড়ে যায় কয়েক গুণ।”
বেচাকেনা যে ইতিমধ্যে বেড়ে গিয়েছে সেটা স্পষ্ট হয়ে যায় পদ্মাপারের লালকূপ হাটের জুতো বিক্রেতা সেকেন্দার আলির কথাতেই। নেই নেই করে প্রায় ত্রিশ বছর ধরে হাটে আসছেন তিনি। সেকেন্দার বলেন, “সামনেই পুজো। আর তার পরেই ঈদ। বেচাকেনাও বেড়েছে। এখানে সপ্তাহে তিন দিন হাট বসে। তাই সপ্তাহের এই তিনটে দিনই এখন ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।” জলঙ্গির স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, দেশভাগের আগে এই লালকূপের হাটই ছিল এলাকার গর্ব। রীতিমত বড় নৌকা নিয়ে হাটে এসে জিনিসপত্র কিনে নিয়ে যেতেন সাহেবরাও। ক্রেতা বিক্রেতাদের ভিড়ে দিনভর গমগম করত এই হাট। তবে এখন আর সেই সাহেবও নেই, নেই হাটের সেই পুরনো মেজাজও। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গিয়েছে অনেক কিছুই। তবে জৌলুস হারালেও হাট কিন্তু থেকেই গিয়েছে নিজের মত করেই সেই পুরনো নিয়ম মতো। এখনও সপ্তাহে তিন দিনই হাট বসে।
কুপিলা হাটের মালিক মহিদুল বিশ্বাস বলেন, “পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় ধরে কুপিলায় হাট বসছে। একটা সময় কুপিলা-সহ আশপাশের গ্রামের মানুষের পোশাক থেকে আনাজ সবই কেনাকাটা হত এখান থেকেই। পরে রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল হওয়ার কারণে মানুষ ক্রমশ বাজারমুখি হয়ে পড়ল। শ্রী হারাতে থাকল গঞ্জের হাটগুলো। তবুও হাট কিন্তু লুপ্ত হয়ে যায়নি। সপ্তাহে দু’দিন করে এখানে আজও হাট বসে। হাটে কম হলেও ক্রেতারা আসেন। তবে পরবের সময়গুলোতে বেচাকেনা কয়েকগুণ বেড়ে যায়।’’ মহিদুল বলেন, “হাটের হতশ্রী চেহারার কারণেও অনেকে আজকাল হাটে আসতে চান না। বৃষ্টি হলে ক্রেতা বিক্রেতা কেউই মাথা গোঁজার জায়গাটুকু পর্যন্ত পান না। জল জমে গিয়ে হাঁটাচলা করাই দায় হয়ে পড়ে। শৌচাগার নেই। প্রশাসন এই বিষয়গুলোর দিকে একটু নজর দিলে হাটের এই হতশ্রী চেহারাটা কিন্তু অনেক পাল্টে যাবে। বহু মানুষ আবার হাটমুখি হবেন।’’
ডোমকলের মহকুমাশাসক প্রশান্ত অধিকারী বলেন, “হাট যে কোনও এলাকারই একটা পুরনো ঐতিহ্য। সেখানে বহু মানুষের জীবন জীবিকা নির্ভর করে। ফলে হাটগুলোকে কিভাবে সংস্কার করা যায় সেই বিষয়ে গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতিগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা হবে।”
মঙ্গলবার বিকেলে লালকূপের হাট থেকে পুজোর বাজার সেরে বাড়ি ফিরছিলেন দিনমজুর কেশব সরকার। কেশববাবু বলেন, “ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে এই হাটে এসেই পুজোর বাজার করতাম। এখন ছেলেদেরকে নিয়ে পুজোর বাজারটা এখান থেকেই সেরে ফেলি। বড় দোকানগুলোতে জিনিসপত্রের যা দাম তা আমাদের মত গরিব মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। সেদিক থেকে হাটই ভাল। এই হাট আছে বলেই না আমাদের পুজো, ঈদ, উৎসব আছে।” |