রবিবার ভোর থেকেই শুরু হয়েছিল উৎকণ্ঠার প্রহর গোণা। থমকে গিয়েছিল ক্যারমবোর্ডের ঝড় তোলা স্ট্রাইকার, কৃষ্ণনগর ষষ্ঠীসঙ্ঘের জগদ্ধাত্রী পুজোর নতুন পরিুকল্পনা, গ্রিন ফুটবল টুর্নামেন্ট নিয়ে আলাপ-আলোচনা। বুধবার বিকেলের পরে ষষ্ঠীতলা বিশ্বাসবাড়ির সামনে কালো পতাকা জানিয়ে দিল সব শেষ। ক্যারম প্রিয় সায়নের স্ট্রাইকার আর বোর্ডের উপরে শব্দ তুলে তাড়া করবে না সাদা কালো ঘুঁটিকে।
টানা পাঁচ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ের পরে হেরে গেলেন রাজ্যের উদ্যানপালন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ দফতরের মন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাসের ছেলে সায়ন বিশ্বাস (২২)। এই দিন দুপুর পৌনে দু’টো নাগাদ ছেলের মৃত্যুর খবরটা বাইরে আসতেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন উজ্জ্বলবাবু। খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ছুটে আসেন প্রাক্তন রেলমন্ত্রী মুকুল রায়। কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালের সামনে তখন আত্মীয়, পরিজন, তৃণমূল বিধায়ক ও নেতা কর্মীদের ভিড় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন তাঁরা। কৃষ্ণনগরে ভিড় জমতে থাকে ষষ্ঠীতলাপাড়ায় মন্ত্রীর বাড়ির সামনে।
শনিবার রাত একটা নাগাদ নিজের বাড়িতে গায়ে পেট্রোল ঢেলে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন সায়ন। ছেলের গায়ের আগুন নেভাতে গিয়ে আহত হন উজ্জ্বলবাবুও। সঙ্গে সঙ্গে সায়নকে প্রথমে শক্তিনগর জেলা হাসপাতাল ও পরে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এই কদিন ধরে সেখানেই চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। এই দিন ময়নাতদন্তের জন্য সায়নের দেহ নিয়ে যাওয়া হয় নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
ষষ্টীতলার অপরিসর রাস্তায় থমথমে মুখে ঘুরছিল সায়নের বন্ধুরা। ওই রাস্তায় লাগানো হয়েছে জোরালো বাতি। সেই আলোর দিকে তাকিয়ে সায়নের বন্ধু কৌশিক মজুমদার বলছিলেন, “জগদ্ধাত্রী পুজোয় আলো নিয়ে নানা রকম পরিকল্পনা ছিল এ বার। কিন্তু আজ এই আলো যেন সহ্য হচ্ছে না।” সায়নের বাড়ির দশ-বারোটা বাড়ির পরেই থাকেন শুভজিৎ সাধুখাঁ। তাঁর কথায়, “ওর সব থেকে বড় যে গুণটা আমাকে টানত, তা হল, সকলের কাছেই প্রিয় হয়ে ওঠার সহজাত ক্ষমতা। বড়দের সম্মান দিত। মন্ত্রীপুত্র হওয়ার পরেও তার কোনও পরিবর্তন দেখিনি। সমবয়সীদের কাছে টেনে নিত।” তিনি বলেন, “উৎসবের সময় সায়নের এই ভাবে আমাদের বোকা বানিয়ে চলে যাওয়াটা মানতে পারছি না। ওকে বাদ দিয়ে দুর্গাপুজোর অষ্টমী কিংবা জগদ্ধাত্রীর ঘট বিসর্জন অসম্ভব।” |
বিবেকানন্দের ভক্ত সায়ন কিছুদিন আগেই তার পিসতুতো দাদা শুভেন্দু বিশ্বাসকে নিজেদের বাড়ি সাজানোর জন্য একটি ম্যুরাল করতে দিয়েছিল। বাড়ির অন্দরে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, “কাজ শেষ করে ফেলেছি প্রায়। কথা ছিল পুজোর আগেই বেলুড় মঠ, কন্যাকুমারিকা এবং বিবেকানন্দের তিনটি ম্যুরাল বাড়ির বসার ঘরে লাগিয়ে দেব। তাতে সব থেকে বেশি আনন্দ যার হত সে এখন সব কিছুর ঊর্ধ্বে।” শুভেন্দুবাবুর মা বৃদ্ধা বিভাদেবী এখনও জানেন না তাঁর আদরের বাবাই আর নেই। বাবাই ছিল সায়নের ডাক নাম। তাঁকে এই নামেই চিনতেন বন্ধুরা ও কাছের আত্মীয়স্বজন।
শুভেন্দু বলেন, “বাবাই ছিল ডানপিটে আর একরোখা। বয়স যখন বারো কি তেরো, একবার বাইক নিয়ে কৃষ্ণনগর থেকে ভিমপুর চলে গিয়েছিল। সেই একরোখা জেদটাই কি ওকে এমন অসময়ে ওকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিল?” সায়ন নেই, বিশ্বাস করতে পারছে না ষষ্ঠীতলা।
বিশ্বাস পরিবারের কাছের লোক তীর্থঙ্কর মণ্ডল বলেন, “আমার সঙ্গে দিন আটেক আগে শেষ কথা হয়েছিল জগদ্ধাত্রী পুজো নিয়ে। সায়নদা বলেছিল, দুর্গাপুজো শেষ হলেই এ বারের পরিকল্পনা শুরু করে দেওয়া হবে। এখন তো আর ভাবতেই পারছি না।” কার্যত কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তাঁর কথায়, “হাজার ব্যস্ততার ফাঁকেও সায়নদা কখন খাচ্ছি, বিশ্রাম পাচ্ছি কি না, সব খোঁজ রাখত। গত বার জগদ্ধাত্রী পুজোর রাতে হঠাৎ বলল হেঁটে হেঁটে ঠাকুর দেখতে যাব। আমরা হাঁটতে হাঁটতে রাজবাড়ি গেলাম। সর্বত্রই ওর চেনা লোকেরা ওকে ঘিরে ধরত।”
সেই ভিড় এই দিন শোকে ভেঙে পড়ে ঘিরে রেখেছিল সায়নহীন সায়নের বাড়ি। |