ক্রিকেটের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যুবরাজ সিংহ যে ভাবে ফিরে এল, সেটা দেখে চিকিৎসক হিসাবে আমি এক কথায় চমৎকৃত। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ওর পারফরম্যান্স শুধু ক্রিকেট বিশ্বেই সাড়া ফেলেনি। ক্যানসার রোগটার সঙ্গে প্রতিদিন যুঝছেন যে সব সাধারণ রোগী, তাঁদের প্রত্যেকের মধ্যে একটা নতুন উদ্দীপনা এনে দিয়েছে। যুবরাজকে দেখে রোগের সঙ্গে লড়ার বাড়তি সাহস পাচ্ছেন তাঁরা। সব থেকে বড় কথা, ক্যানসার রোগ আর রোগীদের সম্পর্কে আমাদের সমাজে আজও প্রচুর জড়তা। নিজের দৃষ্টান্ত দিয়ে সেই জড়তা কাটিয়ে উঠতে সমাজকে সাহায্য করছে যুবরাজ। আমি তো বলব, এই মুহূর্তে ও দেশের ক্যানসার রোগীদের অঘোষিত ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডর।
আসলে ক্রিকেট এমন একটা খেলা, যেখানে শারীরিক সক্ষমতার তুঙ্গে থাকতে না পারলে সাফল্য আসে না। আর সক্ষমতার সেই জায়গাটায় পৌঁছনোর জন্য অসম্ভব পরিশ্রম করতে হয় প্রতিদিন। ক্যানসার রোগীর পক্ষে সেই পরিশ্রম যে করা সম্ভব, সেটা দেখিয়ে দিয়ে যুবরাজ ক্যানসার নিয়ে কিছু চালু ধারণাকে ভেঙে দিয়েছে। আমার কাছে এখন অনেক রোগীই এসে বলছেন, “আচ্ছা যুবরাজ যদি পারে, আমি পারব না কেন?” এই যদি যুবরাজ জনপ্রিয় ক্রিকেটার না হয়ে লেখক হত, তা হলে কিন্তু ওর প্রত্যাবর্তন এতটা প্রভাব তৈরি করতে পারত না।
যুবরাজের ইচ্ছাশক্তিকে কুর্নিশ না জানিয়ে পারছি না। ব্যক্তিগত ভাবে আমি নিজে ওর রিকভারি দেখে সত্যিই আশ্চর্য! কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সহ্য করেও ক্রিকেটের মতো এতটা ফিজিক্যাল একটা খেলায় ও ফিরে এল এবং সেটাও মাত্র তিন মাসের মধ্যে! যুবরাজের যে ধরনের কেমোথেরাপি হয়েছে, তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় শরীরে একটা পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি তৈরি হয়। মানে হাত-পায়ের নার্ভগুলো সব সময় ঝিমঝিম করে। সেই অবস্থায় সাধারণ জীবনে ফেরাটাই সহজ হয় না, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা তো বহু দূরের কথা। যুবরাজ কিন্তু এই পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথিকে অতিক্রম করেছে স্রেফ মনের জোর দিয়ে। আগে নিজের লক্ষ্য ঠিক করে নিয়েছে। তার পর সেটা পর্যন্ত পৌঁছনোর জন্য মনকে এমন ভাবে একাগ্র করে তুলেছে যে, তার সামনে শরীরের আর অন্য কোনও কষ্টই ওকে কাবু করতে পারেনি। ক্রিকেটার হিসাবে যুবরাজের ফিজিক্যাল ক্যাপাসিটি ওকে সাহায্য করেছে ঠিকই। কিন্তু আসল হল ওই মনে জোর।
শুনেছি, মাঝে ও বেঙ্গালুরুর জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে গিয়ে আলাদা করে খেটেছে ফিরে আসার লক্ষ্যে। কেমোথেরাপির পরে শরীরে একটা অদ্ভুত রকমের ক্লান্তি তৈরি হয় যা থেকে আলস্য আসে। সাধারণত রোগীদের মধ্যে দেখেছি, সেরে ওঠার পরেও এই ক্লান্তির কারণে নতুন করে পরিশ্রম করার বা কাজে ফেরার ক্ষেত্রে একটা প্রবল মানসিক বাধা থাকে। যুবরাজ কিন্তু এই ক্লান্তিটাকেও ওর উপর চেপে বসতে দেয়নি। বরং বরাবরের লড়াকু মানসিকতা দিয়ে নিজের পুনর্বাসনের খেলাটা অন্য ভাবে খেলছে। যেখানে কোনও বাধাকেই ও বাধা বলে মনে করেনি।
ইচ্ছাশক্তির জোরে মানুষ যে অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখাতে পারে, যুবরাজ তার সবথেকে বড় উদাহরণ। তবে লড়াই, মনের জোর--এসব বলা যত সহজ, করে দেখানো ততটাই কঠিন। যুবরাজ সেই কঠিন কাজটা শুধু করে দেখায়নি। খুব অল্প সময়ের মধ্যে করে দেখিয়েছে। যে কারণে ওর এই প্রত্যাবর্তনকে আমি যুগান্তকারী ঘটনার থেকে কম কিছু বলে মনে করি না। এত দিন, ক্রিকেটার যুবরাজ তার পারফরম্যান্সের জোরে সবার আদর্শ ছিল। ক্যানসার-যুদ্ধ জয় করে প্রত্যাবর্তনের নায়ক যে যুবরাজ, সে রোগী-আত্মীয়-চিকিৎসক নিয়ে তৈরি যে ক্যানসার পরিবার, সেই পরিবারের সামনে সব থেকে বড় অনুপ্রেরণা। হ্যাঁ, যুবরাজ এখন আমাদের মতো চিকিৎসকদের কাছেও আইডল!
তবে যুবরাজকে কিন্তু সতর্ক থাকতে হবে। ওর যে ধরনের ক্যানসার হয়েছিল, তাতে ২০-৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে পুরোপুরি না সারার আশঙ্কা থেকে যায়। যুবরাজকে আমার পরামর্শ, নিজের চিকিৎসকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলো। ওর রোগটা শরীরের অনেক ভিতরে হয়েছিল বলে বাইরে থেকে দেখে বোঝা যাবে না। তাই আগামী দু’বছর প্রতি দু’মাস অন্তর ওর পরীক্ষা করানো উচিত। তার পর তিন মাস অন্তর। বছর পাঁচেক পর থেকে ছ’মাস অন্তর করালেই চলবে।
সবার শেষে মেনে নিচ্ছি, ওকে নিয়ে আমাদের মতো ডাক্তারদের অনেক ভবিষ্যদ্বাণী, অনেক আশঙ্কাকে যুবরাজ ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে। তবে ওর ক্ষেত্রে ভুল প্রমাণিত হতে পেরে আমরা সত্যিই খুশি। ওর কাছে আমরা হেরে গিয়েছি ঠিকই। কিন্তু হেরেও জিতেছি। ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধে অন্য রোগীরাও যদি যুবরাজের মতো আমাদের হারিয়ে জেতেন, তা হলে আমরা হারতেই চাইব! |