|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
যৌনতার শিক্ষা, আর কবে? |
শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর ‘ব্যক্তিগত মত’, স্কুলে যৌন শিক্ষা প্রয়োজন, কিন্তু
তা মন্ত্রকের ওপর চাপাতে চান না। এই দ্বিধা কবে কাটবে? প্রশ্ন তুলেছেন
মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায় |
মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী একটি মেয়ের আত্মহত্যার খবর মিলল সম্প্রতি। জানা গেল, পরীক্ষার ভয়ে নয়, সে নিজেকে শেষ করেছে ‘অবৈধ’ মাতৃত্বের আশঙ্কায়। একুশ শতকে বিজ্ঞানের মঙ্গল-ছোঁয়া অগ্রগতির সামনে অন্য পথ কেন ছিল না, তা কেউ জানতে চায়নি। এ বিষয়গুলি আলোচিত হয় না, ক্লাসঘরে তো নয়ই।
এ দিকে স্কুলে ‘যৌন শিক্ষা’ পাঠক্রম চালু করা নিয়ে মাঝে মাঝেই নানা কথা, সওয়াল-জবাব চলছে। সে উদ্যোগ আগের ‘জীবনশৈলীর’ মতো অচিরেই বাতিল হবে কি না, কে জানে। প্রসঙ্গত, ‘জীবনশৈলী’র বইটি শিক্ষকদের দেওয়া হয়েছিল, ছাত্রছাত্রীদের নয়। বইটি গোল গোল করে লেখা: ধরি ধরি, কিন্তু ধরা যায় না এমন তার কেতা। সে নিয়ে প্রশিক্ষণও হয়, বিদ্যালয়ের রুটিনেও স্থান পায়। কিন্তু ক্লাস? পড়াবেন কে? আর কেউ পড়াতে চাইলেও বাইরের ‘সমাজ’ কী বলবে? ‘সমাজ’-এর চাপে জীবনশৈলী উধাও। পরাগমিলন থেকে ব্যাঙের যৌন জীবন পর্যন্ত মাধ্যমিকের জীববিদ্যা চর্চার যে ধারা, সে ধারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
এ সেই সমাজ, যেখানে ১৮ বছরের মধ্যে প্রায় অর্ধেক মেয়ের আইনানুগ যৌন অভিজ্ঞতার ব্যবস্থা আছে, ‘বিবাহ’ নামক প্রতিষ্ঠান মারফত। যে সমাজের প্রচারমাধ্যমে উন্মুক্ত নারীদেহের ছড়াছড়ি, বাথরুমের দেওয়াল ভরানো যৌন উদ্গারে। এর প্রত্যেকটিই প্রমাণ করে যে, এই সমাজ যৌনতাকে ‘অস্বাভাবিক’ মনে করে। মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক ‘যৌন শিক্ষা’ প্রবর্তনের প্রস্তাব দিলে সংসদীয় কমিটি তা প্রত্যাখ্যান করেন মোটামুটি একই কারণে। আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে এটি নাকি অপাংক্তেয়। বরং প্রাকৃতিক চিকিৎসা বা আয়ুর্বেদ চলতে পারে। দেখা যাচ্ছে, হেডমাস্টার, হেড অফিসের বড় বাবু এবং জনপ্রতিনিধির মধ্যে এ বিষয়ে কোনও মতানৈক্য নেই।
ও দিকে কাগজ খুললেই শিশুদের ওপর যৌন নিপীড়ন, পাচার, ধর্ষণ-এর ঘটনা, সন্ধের মধ্যেই যার নাটকীয় রূপ টেলিভিশনে। ফলে এটাই প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে যে, সৃষ্টির আদি মুহূর্তগুলি নিষিদ্ধ এবং খারাপ একটি ক্রিয়া: যৌনতা এক ধরনের বিকৃতি। এরই মধ্যে মেয়েদের উপর পুরুষের দখলদারির বীজও নিহিত। বিজ্ঞাপন, পত্রপত্রিকা, সিনেমা, টেলিভিশন, ইন্টারনেট রীতিমত প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে যে, মেয়েদের শরীর আসলে পুরুষের একটি আনন্দভূমি; তার একমাত্র মূল্য বিনোদনে।
|
|
এই অসুস্থতা থেকে মুক্তি দিতে পারে যথার্থ যৌন শিক্ষা। যা ডাক্তারি বইয়ের পাতায় সীমিত থাকবে না, শরীরের পাশাপাশি মনের মুক্তির কথাও বলবে। থাকবে দুটি মানুষের ঘনিষ্ঠতার প্রতি স্বাস্থ্যকর ইতিবাচক সম্মানজনক দৃষ্টিভঙ্গি। বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক পরিবর্তনের সূত্রপাত থেকেই ছাত্রছাত্রীর জানা দরকার যে শরীর তার জীবনে প্রতিবন্ধক নয়। বিশেষ করে মেয়েদের এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নেতিবাচক একটি ধারণা তৈরি করে দেয় সমাজ।
পাশাপাশি, যৌন অভিজ্ঞতা যে একটি মূল্যবান অভিজ্ঞতা, তার পূর্ণতা প্রাপ্তির জন্য উপযুক্ত সময় ও সঙ্গী নির্বাচন জরুরি, এটাও বোঝানো দরকার। নিজের শরীরের প্রতি নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অন্যের মন ও শরীরের উপর দখলদারির মনোভাব যাতে না আসে, সে কথাও বলা যায় এখানেই। কোনও প্রলোভনে, কোনও চাপে যাতে নিজেকে বিপদে না ফেলতে হয়, সেটাও বোঝার বয়স এখনই। ক্লাসরুমে যৌন শিক্ষার পাঠ থেকেই লিঙ্গসাম্যের ধারণা দেওয়া উচিত, দেওয়া যায়ও। যৌনতাকে পুঁজি করে সমাজে যে বিকৃতি চলছে, সে সম্পর্কে চেতনা আনা যায়। ‘ধর্ষণ’ যে একটি বর্বর ক্ষমতার প্রকাশ, এই ধারণা থাকলে মেয়েরা অযথা নিজের শরীর নিয়ে অপরাধবোধে ভোগে না, ছেলেরাও গায়ের জোরের চেয়ে মনের ইচ্ছাকেই সম্মান করতে শেখে।
‘জীবনশৈলী’র ক্লাস নেওয়ার অভিজ্ঞতা যাঁদের হয়েছিল তাঁরা হয়তো অনেকেই দেখেছেন, মেয়েদের ঋতুচক্র, ছেলেমেয়েদের প্রেমে পড়া ও প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কারণ, উভয় ক্ষেত্রেই লেখাপড়ায় মন বসে না কেন, যমজ সন্তান কী ভাবে হয়, ইত্যাদি সাধারণ জ্ঞাতব্য বিষয়ই তারা জানতে চায়। মুশকিল এই যে, ব্যবস্থাপকরা এ বিষয়ে দু’দলে বিভক্ত। এক দল মনে করেন, সুকুমারমতি কিশোরকিশোরীর মনে এ সব ‘খারাপ’ জিনিস ঢোকালে তারা উচ্ছন্নে যাবে। আর এক দল মনে করেন, এ যুগের ছেলেমেয়েরা ‘এত কিছু’ জেনে আছে যে তাদের আর জানানোর কিছু নেই। কী তারা জানে, তা অবশ্য কেউ জানে না, যতক্ষণ না ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্র কোনও এক কনিষ্ঠাকে বলে বসে, ‘তোকে তুলে নিয়ে যাব’। অভিযোগ পেলে তখন অভিভাবককে ডাকা বা লাঠ্যৌষধি প্রয়োগ। খোঁজ নিলে জানা যেত ‘তুলে নেওয়া’ সম্পর্কে শ্রীমানের কোনও ধারণা নেই, চালু কথার প্রয়োগটুকু জানে সে।
অনেক সমস্যার মতো এ ক্ষেত্রেও মূলে আছে অজ্ঞানতা। দেওয়ালে যারা যৌনতা নিয়ে লেখে, তাদের ক্ষেত্রেও অজ্ঞানতাই প্রধান চালিকা শক্তি। বহু বিবাহিত মানুষও এর শিকার। তবু যৌন শিক্ষা নিয়ে আপত্তিটা ঘোর। ছেলেমেয়েরা প্রতিনিয়ত যা শুনছে, যা দেখছে, তা নিয়ে কথা বলা যাবে না। ফলে চোরা পথে জানার চেষ্টায় অজ্ঞানতাই বাড়ছে। সুস্থ মনকে আচ্ছন্ন করছে বিকৃতি। ছেলেমেয়েরা পরস্পরকে বন্ধু হিসেবে নিতে পারছে না, শ্রেণিকক্ষে ছেলেদের ব্যবহারে বিরক্ত মেয়েরা স্কুলে আসা বন্ধ করছে এমন নজিরও আছে। যৌনতার যথাযথ শিক্ষা সমতারও শিক্ষা, আমরা ক’জন জানি সেটা? |
|
|
|
|
|