ব্যক্তিগত ডায়েরি...
আমার ডেঙ্গি-ডায়েরি


৩১ অগস্ট (শুক্রবার)
যখন অফিস এলাম, দিব্যি সুস্থ। কাজের মধ্যেই মালুম হল ব্যথাটা। হাতে-পায়ে আর কাঁধে। হঠাৎ, কিন্তু তীব্র। হাতের চেটো কপালে ছুঁইয়ে বুঝতে পারলাম, বেশ গরম। চোখটাও জ্বালা করছে!
সবে তিনটে। প্যারাসিটামল খেয়ে নেব? না কি, রক্তপরীক্ষা? যদি ডেঙ্গি হয়? আমরাই তো লিখছি, রক্তপরীক্ষা নিয়ে অবহেলা করবেন না।
অতএব ফোন, “দেবদূতদা, মনে হচ্ছে ব্লাড টেস্ট করতে হবে। কোথায় যাই বলো তো?”
দেবদূত ঘোষঠাকুর। পেশায় রিপোর্টার। আসলে হাফ ডাক্তার। অফিসে কারও কিছু অসুখ করলেই তাঁর শরণ। আর ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়া হলে তো কথাই নেই। “ডাঃ নন্দীর ক্লিনিকে চলে যা।”
পৌঁছলাম বিকেল চারটেয়। এক পলক দেখেই ডাক্তার-পত্নী বললেন, “মনে তো হচ্ছে বাধিয়েই এসেছেন।”
শুনে মনে হল, রক্তপরীক্ষা বাহুল্য, যা হওয়ার হয়েই গিয়েছে। তবু নিশ্চিত হতে এন-এস-ওয়ান। রিপোর্ট পেতে রাত হবে। কিন্তু তার জন্য অপেক্ষা না করেই আপাতত কী করব-কী করব না’র একটা তালিকা ডাঃ নন্দী শুনিয়ে দিলেন: এক বোতল জলে এক পাউচ ‘ওআরএস’ গুলে ঘনঘন চুমুক, মদ্যপান তো দূরের কথা, মুসাম্বির রসও নয়। এবং অবশ্যই প্যারাসিটামল।
অফিস ফিরলাম, কিন্তু বসার ক্ষমতা নেই। সময় যত গড়াচ্ছে, তেষ্টাও ততই বাড়ছে। সাড়ে আটটা নাগাদ বাড়ি ফিরলাম। জ্বর ততক্ষণে ১০৩ ডিগ্রি। মাথায় যেন কেউ হাতুড়ি পিটছে। সঙ্গে উথালপাথাল কাঁপুনি, ডাক্তাররা যাকে বলেন ‘রাইগর’।
সাড়ে ন’টায় খবরটা এল। এন-এস-ওয়ান শুধু ‘পজিটিভ’ নয়, ডঃ নন্দীর কথায় ‘জোরদার পজিটিভ’। আমার ডেঙ্গিই হয়েছে। তবে রক্তের প্লেটলেট কমতে শুরু করেনি, ২ লক্ষের কাছাকাছি। পরের দিন বেলা বারোটা নাগাদ ক্লিনিকে গিয়ে ওঁকে আবার দেখাতে হবে। হেঁয়ালি করে বললেন, “ইজিপ্টের মশার কামড় খেয়েছেন মশাই। টিউনিসিয়ার হলে ঝামেলা ছিল না।”
শিল্পী: সুমন চৌধুরী
১ সেপ্টেম্বর (শনিবার)
বেলা ১২টা। চেতলার ক্লিনিক। ডাক্তারবাবু যা বললেন, তার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। আমার ফুসফুসে জল জমার একটা প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অতএব হাসপাতাল।
আমার সাময়িক ঠিকানা অবশ্য মন্দ নয়। এক ধারে বিরাট কাচের জানলা। সংলগ্ন পার্কের সবুজ দেখা যায় না, তবে আকাশটা অনেকখানি। আমার পরনে এখন ডোরাকাটা পোশাক, ঘনঘন সিস্টারদের আনাগোনা, ডান হাত ফুঁড়ে চ্যানেল, শিরায় স্যালাইনের পাশাপাশি জ্বলুনি ধরানো তরল অ্যান্টিবায়োটিক।
জীবনে প্রথম হুইল চেয়ারেও চড়লাম। যিনি ঠেলছেন, লিফটে উঠতে উঠতে তিনি বলছেন, “সরে যান, সরে যান, পেশেন্ট আছে।” চার দিকে সকলে স্বাভাবিক, আমি ‘পেশেন্ট’। পাঁচতলা থেকে গমগমে একতলায় নেমে অস্বস্তি বাড়ল। ঢুকে পড়লাম ‘চেস্ট এক্স-রে’র ঘরে। তার পরে প্লেটলেট গোনার রক্তপরীক্ষা।
ঘরে ফিরতেই চা এল, সঙ্গে দুটো ক্রিম-ক্র্যাকার বিস্কুট। গলাটা শুকিয়ে আসছে, আধ বোতল জল খেলাম ঢকঢক করে, চা টা বিস্বাদ। বিস্কুট ছুঁলাম না।
টিভি চলছিল, দেখতে ইচ্ছে করল না। সিস্টার প্রেশার দেখে, জ্বর মেপে গেলেন। ১০০-র উপরেই। মাথাটাও ধরে আছে। চোখ বুজে শুয়ে রইলাম।
রাত সাড়ে আট টা-র আগেই ডিনার হাজির। জানলাম, এটাই সময়। বড় সাদা ট্রে-র মধ্যে ফয়েল পেপার ঢাকা সাদা বাটিতে ভাত, ডাল, একটা তরকারি, চিকেন। খিদে বোধ ছিল, কিন্তু খেতে গিয়ে দেখলাম, মুখে কোনও স্বাদ নেই। শুয়ে পড়লাম। ঘুমোলামও। খুব ‘ডিসটার্বড স্লিপ’। দশ মিনিট বাদে বাদে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলে কেউ ঘুমোতে পারে!

২ সেপ্টেম্বর (রবিবার)
সাতটা নাগাদ চা এল। ইচ্ছে না করলেও জোর করে বিস্কুট চিবোলাম চায়ে ডুবিয়ে। শরীরে এক ফোঁটা এনার্জি নেই। চোখ বুজে শুয়ে থাকতেই ইচ্ছে করছে। আনন্দবাজার দিয়ে গেল, কিন্তু এক পলক উল্টেপাল্টেই ভাঁজ করে রেখে দিলাম। নিজেরই অবাক লাগল। কী অবস্থা হয়েছে আমার!
সিস্টার এসে স্যালাইনের বোতল বদলে দিলেন।
সাড়ে আটটায় প্রাতরাশ, টোস্ট ডিম মিষ্টি। এবং বুঝলাম, মুখ তেতো হতে শুরু করেছে। না হলে ছানার সন্দেশ কারও তিতকুটে লাগে?
ডায়েটিশিয়ান ভদ্রমহিলা জিজ্ঞেস করলেন, কী খেতে ইচ্ছে করছে? বললাম, কিছুই না। একটু উচ্ছে বা করলা খাওয়াতে পারেন? যদি তেতোয় তেতোক্ষয় হয়। “সঙ্গে চিকেন না মাছ?” বললাম, দুটোর কোনওটাই নয়। উনি মাথা নাড়লেন, “তা বললে কি হয়? আপনার প্রোটিন দরকার। আমি আপনাকে ‘র বেনানা’ দিয়ে রুই মাছ করে দিতে বলছি।” ঘন্টা দুয়েক পরে কাঁচকলা দিয়ে মাছের ঝোল গলা দিয়ে নামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলাম।
সন্ধেবেলা ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে কবে ছাড়বেন। কোনও সদুত্তর পেলাম না।

৩ সেপ্টেম্বর (সোমবার)
বোতলের পর বোতল সাবাড় করেও রাতভ’র মুখ শুকিয়ে কাঠ, সকালে উঠেও কোনও অব্যাহতি নেই। সিস্টারদের আনাগোনা, প্রেশার দেখা, টেম্পারেচার মাপার বিরাম নেই। জ্বর কমতে শুরু করেছে। কিন্তু অসীম ক্লান্তি। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, চোখ খুলতেও নয়।
প্রশ্ন একটাই, এই বন্দিত্ব থেকে মুক্তি কবে। ঠিক করলাম, সন্ধের পরে ডাক্তারবাবু এলে আবার জিজ্ঞেস করব। মধ্যরাত পেরিয়ে উনি এলেন। বিভিন্ন নার্সিংহোমে ওঁর এত ডেঙ্গি-রোগী যে সবার কাছে যেতে গিয়ে এত দেরি। তখনই আমার প্লেটলেট কাউন্ট নিতে বলে গেলেন। সাড়ে বারোটায় রক্ত নিয়ে গেল। বার বার গলা শুকোচ্ছে, ছটফট করছিলাম।
একটু বোধ হয় তন্দ্রা এসেছিল, হঠাৎ মনে হল কেউ আমাকে ডাকছে। দক্ষিণী টানে হিন্দিতে। চোখ খুলে দেখলাম দু’জন সিস্টার। “শুনুন, শুনুন, আপনার প্লেটলেট খুব নেমে গেছে। ৬০ হাজারেরও নীচে। কাল প্লেটলেট দিতে হতে পারে। ডোনর লাগবে।” ধড়মড়িয়ে উঠে বসতে গিয়ে হ্যাঁচকা টান লাগল চ্যানেলে। হতভম্ব অবস্থা। ওই ভোর রাতে ওই রকম একটা পরিবেশে একটু ভয়ভয়ও লাগছিল। এখন আমি কী করব?
মিনিট দশেক পরে ফিরে এলেন ওঁরা। অনেক কিছু বললেন, পুরোটা বুঝিনি। মনে হল বলতে চাইলেন, দুশ্চিন্তার কারণ নেই। প্লেটলেটের যে কাউন্টটা ওঁরা বলেছিলেন এক্ষুনি, সেটা বোধ হয় ঠিক নয়। তবু আশ্বস্ত হলাম না।

৪ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার)
ধীরে ধীরে আলো ফুটল বিষণ্ণ সকালে। চা-বিস্কুট সব বিস্বাদ। আমার একটাই জ্ঞাতব্য। প্লেটলেট কত।
বেলার দিকে জানা গেল লটারি জিতেছি। প্লেটলেট ১ লক্ষ ৩০ হাজার। ডিসচার্জ সার্টিফিকেট নিয়ে বিকেলে যখন ওআরএস মেশানো জলের বোতল হাতে গাড়িতে চড়লাম, মনে হল কত দিন পরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি। খুব দুর্বল, ড্রিপের চ্যানেল খোলার পরেও হাত টনটন করছে। ডাক্তারবাবু বলে দিয়েছেন আলাদা ঘরে খুব সাবধানে থাকতে হবে (কারণ শ্বেতকণিকা খুব কমে যাওয়ায় সংক্রমণের জোর সম্ভাবনা), তবু ভাল লাগল।

৫ সেপ্টেম্বর (বুধবার)
দিন শুরু রক্তদান দিয়ে। রোজই চলবে আপাতত। মুসাম্বি জাতীয় ফল খাওয়া বারণ, পাকা পেঁপে আর আপেল চলবে। মুশকিল হচ্ছে পাকা পেঁপের অধিকাংশ এমনিতেই বিস্বাদ।
ডায়েটিশিয়ানদের সঙ্গে কথা বলে এক গুরুজন পর পর পাঁচটি এস এম এস করলেন, ডব্লুবিসি বাড়ানোর জন্য আমার কী কী খাওয়া উচিত। ওমেগা থ্রি সমৃদ্ধ মাছ, চিকেন স্টু, ছানা, আখরোট ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু খাব কী, খাবার দেখলেই তো আতঙ্ক হচ্ছে। নিতান্ত জোলো রান্নাও বিষ ঝাল মনে হচ্ছে। বা নুনে পোড়া।
রাতে রিপোর্ট এল। প্লেটলেট ঠিক আছে, প্রায় দেড় লক্ষ। কিন্তু শ্বেতকণিকা বাড়ন্ত। ২৬০০। হওয়া উচিত অন্তত ৪০০০।

৬ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার)
এত দিন কাগজ পড়তে ইচ্ছেই হয়নি। বড়জোর প্রথম পাতায় চোখ বুলিয়েছি। এই প্রথম কাগজগুলো পড়ার চেষ্টা করলাম। খানিকটা পড়লামও। কিন্তু আজও কিছু খেতে পারলাম না। জল খেয়ে খেয়ে পেট জয়ঢাক হয়ে গেলেও খিদে পাচ্ছে। অথচ খাওয়া যাচ্ছে না।
ডব্লুবিসি বেড়েছে, কিন্তু এখনও কিছু পথ বাকি। ৩৬০০।
সারা দিন শুয়ে থেকেও রাত নটা বাজলেই ঘুমে চোখ ভেঙে আসছে। এ সময়ে অফিসে আর এক বার চা খাই।

৭ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার)
আমার ডেঙ্গির সপ্তাহপূর্তি।
অফিসে দিবারাত্র নিউজ চ্যানেল চলে। অন্য সব চ্যানেলে কখন কী হয় জানতাম না। এখন আমি প্রোগ্রাম-বিশেষজ্ঞ। শুয়ে শুয়ে হাঁপিয়ে উঠছি। এত শোওয়া জীবনে শুইনি তো। কাগজ দেখছি পড়তে ইচ্ছে করছে না।
শুধু দুটো জিনিস খেতে ভাল লাগছে। ডাবের জল। আর দুপুরের পরে টক দই।
কোথায় একটু বাড়বে, ডব্লুবিসি ১০০ কমে গেছে। কী কাণ্ড!

৮ সেপ্টেম্বর (শনিবার)
কত দিন অফিস যাই না। হাঁসফাঁস করছি। কিন্তু ৪ হাজার না হলে ডাক্তারবাবুকে বলতেই সাহস পাচ্ছি না। শরীরেও দেবে না। মিনিট তিনেক কথা বললেই দম ফুরিয়ে যাচ্ছে।
দুপুর থেকে নতুন উপসর্গ। ডান হাতের চেটো চুলকোতে শুরু করেছে। ক্রমশ বাড়ছে। মনে হচ্ছে যেন কেউ আলতা লেপে দিয়েছে।
ডাক্তারবাবুকে ফোন করতে হেসে বললেন, এ তো হবেই। ভূত ছাড়ার মতো ডেঙ্গির ভাইরাস শরীর থেকে বেরোচ্ছে। দু’রকম অ্যান্টিঅ্যালার্জিক খেতে বললেন। বিশেষ কাজ হল না। প্রায় বিনিদ্র রাত্রি।
ডব্লুবিসি বড় কৃপণ, ১০০ বেড়েছে। প্লেটলেট বরং সদয়। দু’লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে।

৯ সেপ্টেম্বর (রবিবার)
ডান হাতের চেটোর পাশাপাশি বাঁ হাত-ও আক্রান্ত। টকটকে লাল। সারা দিন দু’হাত নিয়ে ব্যস্ত রইলাম।
ভূত যদি ছাড়ছেই, ডব্লুবিসি বাড়ছে না কেন? এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। তবে আজ যেন অন্য দিনের চেয়ে একটু তৃপ্তি করে খেলাম। একটু ঝাল লাগলেও নোনতা লাগেনি।

১০ সেপ্টেম্বর (সোমবার)
চুলকোনো কমেছে। লাল ভাবটাও প্রায় নেই। ঠ্যাঁটা ডব্লুবিসি ৪০০০ ছাড়িয়ে ৪১০০। প্রথম ফোনটাই ডাক্তারবাবুকে: কাল থেকে অফিস যেতে চাই। বললেন, আর দুটো দিন বিশ্রাম নিলে হয় না? বললাম, এ বার নির্ঘাত পাগল হয়ে যাব। অগত্যা অনুমতি দিলেন, কিন্তু খুব সাবধানে থাকতে হবে। প্রথম দিকে ঘন্টা দুয়েকের বেশি নয়। জল খাওয়া যেন না কমে। বেশি কথাবার্তা না বলাই ভাল।
বন্ধু চোখের ডাক্তার শৌভিক (বন্দ্যোপাধ্যায়) ক’টা ডাক্তারি-মাস্ক দিয়ে গেল। নাকে লাগিয়ে রাখতে হবে। ইনফেকশন আটকাতে। বললাম, লাগাব। কিন্তু ও রকম লাগিয়ে রাখা যায় নাকি?

১১ সেপ্টেম্বর (মঙ্গলবার)
অফিস যাব শুনে হাঁ হাঁ করে উঠল সবাই। আবার বাড়াবাড়ি হলে? না, আসলে আমি একটু দম নিতে চাই।
জলের বোতল আর ছানা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম নাইন ইলেভেনে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.