|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
বনধ মানে বিনোদন? মানতে পারলাম না |
অভিজিৎ তরফদার |
সম্প্রতি আরও একটি বন্ধ পালিত হল। কর্মের স্পন্দনহীন দিনটি অতিবাহিত হওয়ার পর যে-সমস্ত প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল, তা মূলত এই রকম:
ক) বনধ পক্ষীয়রা বললেন, খুচরো ব্যবসায়ে বহুজাতিক প্রবেশ দেশের সর্বনাশ করবে, ডিজেল ও রান্নার গ্যাসে মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের দুর্দশা আরও বাড়াবে। বিপক্ষে যাঁরা, তাঁরা যুক্তি ও পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করলেন, দেশের অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় এই সিদ্ধান্তের প্রয়োজন ছিল।
খ) যে কোনও বনধই দেশের অর্থনীতির পক্ষে ক্ষতিকর। কয়েক হাজার কোটি টাকা দেশের আয় থেকে এক দিনে বিযুক্ত হয়ে গেল। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে বনধকে আর ব্যবহার না করাই ভাল। বহু-ব্যবহারে এই প্রতিবাদের শেষ অস্ত্রটি ক্রমশ ভোঁতা হয়ে গিয়েছে।
গ) বনধ মানে নিছক বিনোদন। মানুষ বনধের দিনটিকে আর একটি ছুটির দিন হিসেবে দেখতে শুরু করেছে। বনধের আওতা থেকে সিনেমা-থিয়েটার ইত্যাদি বিনোদনকেন্দ্রগুলিকে বাদ রাখলেই ভাল হয়।
বনধ-সংশ্লিষ্ট প্রতিক্রিয়া যা যা উপরে বর্ণিত হল, তার কোনওটির সম্বন্ধেই আমার কোনও বক্তব্য নেই। বরং অন্য দুয়েকটি বিষয়ে মনস্বী পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। |
মৃত্যুর মিছিল |
সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে পঁচিশ বছর যুক্ত থেকে সম্প্রতি স্বেচ্ছা-অবসর নিয়েছি। পি জি হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগে কাজ করতে গিয়ে অনেকগুলি বনধের মুখোমুখি হতে হয়েছে। যে কোনও বন্ধের পর দিন হাসপাতালে গিয়ে প্রথমেই চরম উৎকণ্ঠার সঙ্গে মাথা গুনতি শুরু করতাম। কাল যাঁদের দেখে গিয়েছি, সকলে আছেন তো? একটি বনধ মানেই মৃত্যুর মিছিল।
কেন?
বামপন্থী আন্দোলনের পুরোধা, পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় যিনি এই মতাদর্শে বিশ্বস্ত থেকেছেন, অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় এক জননেতা অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করেছিলেন, বনধ-এর আওতা থেকে তো আমরা হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য পরিষেবাকে বাদ দিয়েছি। তা হলে তুমি এত ক্ষুব্ধ হচ্ছ কেন?
সেই বহুদর্শী মানুষটিকে আমি কেমন করে বোঝাই, আউটডোর বা ডায়ালিসিসঘরের চাবি খুলবেন যে মানুষটি, স্ট্রেচার-এ রোগীকে টেনে নিয়ে যাবেন যে কর্মচারী, ডায়ালিসিসের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় জলের প্লান্ট চালাবেন যে কর্মীটি, তাঁরা কেউই হাসপাতালে থাকেন না। ক্যানিং কিংবা পূর্বস্থলী থেকে ভোরের ট্রেন ধরে যে মানুষটির আসবার কথা, তিনি এসে পৌঁছবেন না। ফলে, হয় হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে রোগীটি ডায়ালিসিসে আসবেন না, অথবা এলেও ডায়ালিসিস পাবেন না। এমনকী যে মুমূর্ষু রোগীটি হাসপাতালেই ভর্তি, তাঁরও আত্মীয়স্বজন তাঁকে দেখতে আসতে পারবেন না। যে কোনও জরুরি পরিস্থিতিতে ওষুধের প্রয়োজন হলে (সরকারি হাসপাতালে জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহৃত অনেক ওষুধই অমিল) কর্তব্যরত সেবিকা অসহায়ের মতো ছুটোছুটি করবেন, চিকিৎসক তাঁর জ্ঞান-বুদ্ধি-মেধার শেষতম বিন্দুটি দিয়ে চেষ্টা করবেন, তথাপি রোগীটিকে বাঁচাতে পারবেন না।
বৃহত্তর জনকল্যাণে একটি-দু’টি মৃত্যু সভ্যতা মেনে নেয়, এমনটাই জনশ্রুতি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে সমষ্টি নয়। যে কোনও মৃত্যুই যন্ত্রণার, বিশেষত তাঁর নিকটজনদের কাছে। হৃদয়হীনতা কখনও জনকল্যাণের পরিপূরক হতে পারে না। |
সফল বন্ধ, ব্যর্থ বনধ |
এ বার অন্য একটা প্রসঙ্গে যাই। সর্বাত্মক বন্ধ হওয়ার জন্য বনধে যোগ দিয়েছেন যে-সব মানুষ, তাঁদের সংগ্রামী অভিনন্দন জানিয়েছেন বনধ-সমর্থকরা। অন্য দিকে বনধে শামিল না হয়ে যাঁরা কাজ করেছেন, বিশেষত সরকারি কর্মীরা, তাঁদের অভিনন্দন জানিয়েছেন বনধ-বিরোধীরা। সরলীকৃত ভাষায়, যে সব ব্যক্তি কাজে আসেননি, ‘ছুটি’ কাটিয়েছেন, তাঁরা বনধ কে নীতিগত সমর্থন জানিয়েছেন। আর যাঁরা কাজে এলেন, তাঁরা কর্তব্যকর্মে নিষ্ঠার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন। |
সত্য কি এতটাই সহজ? |
প্রজ্বলিত প্রদীপের শিখাটির দিকে তাকিয়ে আমরা অনেক সময় নীচে জ্বলতে থাকা সলতের অগ্নিদগ্ধ যন্ত্রণার কথা বিস্মৃত হই। যে সব মানুষ বনধের দিনে কাজে বেরোলেন না, তাঁদের স্মৃতিতে এখনও জাগরুক বনধের দিনে কাজে বেরিয়ে মলোটভ ককটেলে ঝলসে যাওয়া আর একটি মানুষের ভবিতব্য। যানবাহনের মালিক যাঁরা গাড়ি বের করলেন না, তাঁদের মনে আশঙ্কা, বনধের দিনে গাড়ি ভাঙচুর হলে ইনশুয়োরেন্স কোম্পানি যদি টাকা না দেয়! যে সামান্য দোকানদার দোকান খুললেন না, তিনি ভাবলেন, বনধ-সমর্থকরা যদি দোকানে এসে লুঠপাট চালায়, দোকানের ক্যাশবাক্সে হাত দেয়! খোঁজ নিয়ে দেখুন, যে একশো জন মানুষ বনধের দিনে কাজে বের হননি, তাঁদের নব্বই জনই তা করেছেন যে-প্রবৃত্তির তাড়নায়, তার নাম ভীতি, তার নাম আতঙ্ক।
আবার যাঁরা কাজে এলেন, তাঁরা? যে সরকারি কর্মচারীটি সাতসকালে উঠে দুর্গানাম জপতে জপতে কর্মস্থলে পাড়ি দিলেন, যাঁর স্ত্রী টিফিন গুছিয়ে দিতে দিতে স্বামীর কপালে প্রসাদী ফুল ছুঁইয়ে দিলেন, তিনি বীরদর্পে বনধ ব্যর্থ করতে প্রাণ হাতে করে রাস্তায় নামলেন? না, তিনিও যে কর্মস্থলে গেছেন, তার পিছনে কাজ করেছে ভয়। কাজে না গেলে কারণ দর্শানোর চিঠি, কারণে সন্তুষ্ট না হলে বেতন কাটা, চাকরিতে ছেদ, অবসরকালীন সুযোগসুবিধা হ্রাস, সার্ভিস বুক-এ এন্ট্রি। অর্থাৎ, কাজে যোগ দেওয়ার পিছনেও যা কাজ করছে, তা আদর্শ নয়, কাজের প্রতি ভালবাসা নয়, বনধ ব্যর্থ করার প্রেরণা নয়, অধিকাংশ মানুষ আক্রান্ত যাতে, তার নাম ভয়, ভয় এবং ভয়।
দূরদর্শনের পর্দায় দেখলাম, এক জন মন্তব্য করেছেন, এমন নিছক বিনোদনের দিন আর ক’টা পাওয়া যায়? ঘরে বসে টিভিতে সিনেমা দেখা, ভালমন্দ খাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, এর নামই বন্ধ। আমি উদাহরণটা অন্য দিকে সরিয়ে দেব। ছুটির দিনে দুপুরে আপনি দিবানিদ্রা দেন। ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে কাঁপতে কাঁপতেও আচ্ছন্ন হয়ে আপনি দ্বিপ্রহরে শয্যায় লম্বমান হন। দুটোর প্রেক্ষিত কিন্তু এক নয়।
বছরের ন’মাস অতিক্রান্ত। ক্যাজুয়াল লিভ প্রায় শেষ। সেইখানে দাঁড়িয়ে একটি কাজের দিনকে ছুটিতে রূপান্তরিত করে তাঁর শেষ হয়ে আসা ছুটির ভাণ্ডার ফাঁকা করতে কোনও মূর্খই স্বেচ্ছায় চাইবে না, ছুটিটা সে রাখতে চাইবে দুর্দিনের সঞ্চয় হিসেবে। সুতরাং, যদি আইনি পদক্ষেপ না-ও নেওয়া হয়, চাপিয়ে দেওয়া কারণে অর্জিত ছুটি ক্ষয় করে ফেলাও কোনও কর্মীরই অভিপ্রেত হতে পারে না।
যে দিক দিয়েই দেখি, বনধের দিনে যাঁরা বাড়িতে বসে রইলেন, তাঁরাও যেমন বেশির ভাগই অন্তর থেকে বনধের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সহমত পোষণ করেছেন, এমন ভেবে নেওয়ার কারণ নেই; বিপরীতে, যে সব কর্মী শত প্রতিবন্ধক অতিক্রম করেও অফিসে পৌঁছেছেন (কাজ হয়েছে কি না, সে প্রশ্ন অবশ্য অবান্তর), তাঁরাই যে বনধ ব্যর্থ করবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছনোও ঠিক হবে না।
এই নিবন্ধটি লিখে যখন লেফাফাবদ্ধ করেছি, আমার সংসারের কর্ত্রী দু’টি প্রশ্ন আমাকে করেছিলেন। প্রথমত, এই জাতীয় রচনা বনধ সম্বন্ধে মানুষের ধারণা বদলে দিতে এক বিন্দুও সমর্থ হবে কি না; দ্বিতীয়ত, আমার যে দু’টি অপ্রাপ্তবয়স্ক কন্যা প্রতিদিন স্কুল-কলেজে যাওয়া-আসা করে, লেখার আগে তাদের নিরাপত্তা বিষয়ে আমি আদৌ কিছু ভেবেছি কি না!
ওই যে বললাম, ভয়! |
|
|
|
|
|