বিতর্ক...
অটো থাকলে অনিয়মও থাকবে
পক্ষে
চাঁদার ফাঁদে বন্দি নেতারা
অটোর বাড়বাড়ন্ত ও দৌরাত্ম্যের কারণ রাজনৈতিক প্রশ্রয়। কারণ, ব্রিগেড ভরাতে এরাই বড় অংশ। তার ওপর পরিবহণ ধর্মঘট সফল করে জনজীবন স্তব্ধ করতে এরাই বড় সহায়। আর একটা প্রধান কারণ আছে, সেটা অর্থনৈতিক। খুব সহজেই একটা হিসাব দিয়ে বলি সোনারপুর এলাকায় প্রায় দেড় হাজার অটো চলে। তাদের প্রত্যেক দিন পাঁচ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়। তা হলে, প্রতিদিনের চাঁদার পরিমাণটা হল ১৫০০×৫=৭৫০০ টাকা। তা হলে এক মাসে এই চাঁদার পরিমাণটা হল ২ লক্ষ ২৫ হাজার। সুতরাং, এক এক বছরের চাঁদার পরিমাণটা কত দাঁড়ায়? এটা তো একটা এলাকার কথা, সারা পশ্চিমবঙ্গের হিসাব ধরলে তা কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে, যেটার মালিক হল শাসক দলের কোনও নেতা। এর থেকে কিছু অংশ পার্টি ফান্ডে যায়। সুতরাং, এঁদের বরাভয়-হস্ত অটোচালকদের মাথায় থাকবে না, তা কি হয়? সেটা আগের সরকারের আমলে ছিল, এখনও আছে। কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে পরিবহণ মন্ত্রীদের-অটোচালকদের বিরুদ্ধে কথা বলতেই হয়, কিন্তু আসল হিসেবটা একই থাকে। তাই অটোচালকদের আইন ভাঙা চলতেই থাকবে। এরা ভুলে যায়, যাত্রীদের টাকায় তাদের চাল-ডাল কেনা হয়।


লাইসেন্স-বিহীন ও রুট পারমিট-হীন অসংখ্য অটো দিনের পর দিন রাস্তায় চললে অনিয়মটা নিয়ম হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। পেট্রোল-ডিজেল-গ্যাস-এর দাম বৃদ্ধি সত্ত্বেও মন্ত্রী যখন নির্দেশ দেন, ভাড়া বাড়ানো যাবে না এবং যাত্রীও চার জনের বেশি নেওয়া যাবে না, তখন সেখানে অনিয়মটাই নিয়ম হতে বাধ্য। যে সমাজে ভোগবাদে নিমজ্জিত ব্যক্তিদের দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের কথা বলা হয় এবং তাঁদের আইকন হিসেবে দেখে তাঁদের জীবনধারাকে অনুসরণ করা হয়, সেখানে লোভনীয় দামি ভোগ্যদ্রব্য পেতে অতিরিক্ত অর্থোপার্জনের জন্য অটোচালকদের ছোটখাটো অনিয়ম না করলে চলবে কী করে?

‘দাদা, ছাড়ুন এ বার। চার জন তো হয়ে গেছে।’ ‘কী যে বলেন, একটু আগে-পরে বসুন না, পিছনে এক জন আর আমার পাশে আরও দু’জন না হলে যে ট্রিপটা লস হয়ে যাবে দাদা।’
সেই আকাঙ্ক্ষিত তিন জন এলেন, তারপর চালক বেঁকে কোনও রকমে বসে (প্রায় দাঁড়িয়ে) যানটিকে রওনা করালেন। যানটির আর্তচিৎকার, মনে করায় ছোটবেলার দু’টি লাইন ‘রেগে বলে দন্ত্য ন, যাব না তো কখ্খোনো’।
বেশির ভাগ নিত্যযাত্রিবাহী পরিবহণে খালাসি থেকে কন্ডাক্টর থেকে চালকে পদোন্নতি খুব স্বল্প সময়েই হয়ে যায়। সেই চালকের না আছে ড্রাইভিং লাইসেন্স, না আছে যানটির বৈধ পরিচয় কাগজ। শুধু ‘দেখে শিখে’ তিনি আজকে কত মানুষকে দায়িত্ব নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছেন। অনেক চালক আবার আসনটিতে বসেন মানবিক গুণগুলি বাড়িতে রেখে এসে। তাই তো শিশু অটো থেকে ছিটকে পড়ে গেলেও চালক কিন্তু তাঁর যানটিকে থামাতে চান না। নিয়মের বেড়াজালে এঁদের বাঁধা যাবে না। চাই সমবেত প্রতিবাদ। আবার আমরা, যাঁরা চোখে আঙুলদাতা, তাঁরাও কিন্তু সব জেনে-বুঝেও তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছতে ডান দিকের সিটে অর্ধেক বসেও বেমালুম চলে যাই। তাই ‘অটো-অনিয়ম’ সমার্থক নয়, বিপরীত দু’টি মেরু করাই আমাদের প্রতিজ্ঞা, দায়বদ্ধতা হওয়া উচিত।

বিপক্ষে
অন্যরা যেন সুবোধ বালক
সরকার নিয়ম করেছে অটোতে চার জনের বেশি নেওয়া চলবে না। যাত্রীরা এসে এই নিয়মটা ভাঙতে অটোচালককে উৎসাহ দেন ‘ছাড়ুন তো মন্ত্রীদের কথা, ওঁদের তো যাওয়া-আসা করতে হয় না’ বলে চালকের ডান পাশে বসে যাবেন। আবার, ওই যাত্রী ভিড় বাসে উঠে কন্ডাক্টরকে বলেন, ‘আরও প্যাসেঞ্জার তুলছ কেন? আমরা কি গরু-ছাগল?’ অটোচালকদের দাদাগিরি এই সব মেনিমুখো যাত্রীদের জন্য আজ বাড়বাড়ন্ত। আর অনিয়ম? অনিয়মে যারা অভ্যস্ত, তাদের নিয়মে বাঁধতে একটু সময় লাগে। কিন্তু মনে রাখতে হবে,
(১) কলকাতায় এক সময় খাটাল ছিল, এখন নেই।
(২) ‘কাটাতেল’-এ অটো চলত, এখন নেই (শহরতলি বাদে)।
(৩) যে কোনও পোশাকে ট্যাক্সি চালানো যেত, এখন নেই।
(৪) ১৫ বছরের পুরনো গাড়ি রাস্তা ভরে থাকত, এখন কমে এসেছে।
(৫) পুজোর উপাচার-বর্জ্য নদীতে ফেলা হত, এখন ডাঙায়।
(৬) এখন ট্যাক্সিতে ভাড়ার রসিদ দেওয়া হয়। সুতরাং, কড়া মনোভাব রেখে সরকারকে ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। ‘অটোও থাকবে নিয়মেও চলবে’। শুধু যাত্রীদের একটু সাবালক হতে হবে। যা করবে সরকার, আমরা ‘শিশু’ এমন মনোভাব ত্যাগ করতে হবে।
অটো না থাকলেও কিন্তু বহু অনিয়ম থাকবে। যেমন, বাসে বাসে রেষারেষি। ট্রাফিক পুলিশকে ‘উপযুক্ত দক্ষিণা’ দিয়ে ভারী ট্রাক-লরির নিষিদ্ধ রাস্তায় অবাধ চলাচল। গন্তব্য পছন্দ না হলে ট্যাক্সির যাত্রী প্রত্যাখ্যান। দূষণ-বিধির তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন গাড়ির নির্দ্বিধায় যাতায়াত। এ ছাড়া, হেলমেট ছাড়াই মোটরবাইকচালক বা সঙ্গীর নিশ্চিন্ত এবং বেপরোয়া চলাফেরাও থেকে যাবে। আর আছে সিগন্যাল না-মেনে যানবাহন এবং পথিকের যেমন খুশি চলাফেরা এবং তার ফলে সৃষ্টি জটিল যানজট। তাই, অনিয়মের ভূত শুধু অটোতেই ঘর বেঁধেছে এমটা ভাবা ভুল। রাস্তার নানামুখী অনিয়মগুলো দূর করতে যে ধারাবাহিক প্রশাসনিক দৃঢ়তার প্রয়োজন ছিল, তা আগেও দেখা যায়নি, এখনও অনুপস্থিত।বহু বার ভারতের বিভিন্ন রাজ্য সফরের সুবাদে বিস্তর অটো চড়েছি নির্বিঘ্নে, ‘চার জনের বেশি যাত্রী নয়’ নিয়ম মেনে। অনেক শহরে, বিশেষত ভুবনেশ্বর ও চেন্নাই শহরে কাজের তাগিদে একা একা অনেক রাত্রে অটোভ্রমণে কোনওদিন কোনও অনিয়ম চোখে পড়েনি, বরং শুনশান রাস্তার ক্রসিংয়েও দেখেছি সঠিক ভাবে নির্দিষ্ট সিগন্যাল মেনে অটো চলতে। বাংলায় যাত্রীসংখ্যা ও অটোর সংখ্যার মধ্যে ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্ক থাকলেও, সারা ভারতে তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে যদি সুন্দর নিয়ম মেনে সুস্থ পরিবেশে অটো চলতে পারে, তবে উপসর্গ অনুযায়ী রোগ নির্ণয় করে আরোগ্যর প্রতিষেধক আবিষ্কার করলে অটো চলবে তরতরিয়ে, অনিয়ম-বেনিয়ম ছাড়াই। অটোচালকরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সংসার চালায়। তাদের যানটি ছোট, কিন্তু তাদের জন্য নিয়ম অনেক বড়, ড্রেস পরতে হবে, রুটের বাইরে যাওয়া চলবে না, চার জনের বেশি যাত্রী বহন চলবে না। বাস-মিনিবাস এখনও সংখ্যায় অপ্রতুল। যাত্রীদের ভরসা অটো। কয়েক জনের জন্য আমরা সব অটোচালককে যেন ভিলেন না বানাই।

নভেম্বর মাসের বিতর্ক
আপনার চিঠি পক্ষে না বিপক্ষে, তা স্পষ্ট উল্লেখ করুন।
চিঠি পাঠান ২৫ অক্টোবরের মধ্যে এই ঠিকানায়
নভেম্বর মাসের বিতর্ক,
সম্পাদকীয় বিভাগ,
আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.