‘টাইগার ট্যুরিজম’ চলবে না সুপ্রিম কোর্টের এই আদেশে অনেকেই ক্ষুব্ধ।
বাঘেদের দিক থেকে ব্যাপারটা নিয়ে ভেবেছেন
বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী |
বাঘের দেশে প্রবেশ নিষেধ, মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশ জারি হওয়া মাত্র চার দিকে শোরগোল পড়ে গেছে। যাঁরা বন্যপ্রাণীর আলোকচিত্রী, তাঁরা অসহায়। যাঁরা বন্যপ্রাণী নিয়ে ব্যবসা চালান তাঁরা ভীত, ব্যাঘ্র-প্রকল্পগুলোর আশেপাশে যাঁরা হোটেল-ব্যবসা চালান, পর্যটকদের নিয়ে যাঁদের জিপসির ব্যবসা, বন্যপ্রাণীর গাইড-- সবাই নিজেরা বিপন্ন বোধ করছেন।
একমাত্র নিশ্চিন্ত বোধহয় বাঘেরা। নিঃসন্দেহে এই আদেশ তাদের উপর থেকে অত্যাচারের চাপ কমাবে। এই নির্দেশে পর্যটনের উপর নিষেধাজ্ঞা ছাড়াও আর একটু সংযোজন থাকলে বোধহয় ভাল হত। যেটা হল, গোটা-পাঁচেক ব্যাঘ্র-প্রকল্পে দেশি ও বিদেশি চ্যানেলের প্রায় নিয়মিত শ্যুটিং-এর ওপর নিষেধাজ্ঞা। কয়েক বছর আগে বান্ধবগড়ে এক বিশ্বখ্যাত আমেরিকান চ্যানেলকে দেখেছিলাম বিভাগীয় হাতি নিয়ে পনেরো ফুট এক ক্রেনের উপর টানা একুশ দিন, এক সদ্য মা-হওয়া বাঘিনি আর তার তিনটি বাচ্চার ভিডিয়ো শ্যুট করতে। একনাগাড়ে মানুষের উপস্থিতিতে বাঘিনিটার স্বাভাবিক ভাবে শিকার ধরা ও বাচ্চাকে খাওয়ানোর খুবই অসুবিধে হচ্ছিল। প্রতিবাদ করায় ক্যামেরাম্যান মেয়েটি পকেট থেকে দিল্লির প্রজেক্ট টাইগারের অনুমতিপত্র দেখিয়ে দেয়। |
ব্যাঘ্র প্রকল্পগুলিতে পর্যটনের নামে সাধারণত যা হয়ে থাকে, বাঘ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর উপর এক নির্মম অত্যাচার। কানহা, বান্ধবগড়, তানোবা করবেট প্রভৃতি জঙ্গলে অগুনতি গাড়ি যে ভাবে বাঘের পথ আটকে দাঁড়িয়ে থাকে, তাতে করে বাঘের গতিবিধি ও স্বাভাবিক আচরণে ব্যাঘাত ঘটে। ঢাউস সেডান গাড়িতে কালো কাচ তুলে বাতানুকূল যন্ত্র চালিয়ে ভি আই পি-দের বাঘের জন্য অপেক্ষা করতে। বাঘের দেখা পেলে কালো কাচ সামান্য নামিয়ে ডিজিটাল ক্যামেরা বের করে ফটাফট ছবি তুলে বীরদর্পে চলে যেতে। বাঘের এ দিক থেকে ও দিক যাওয়ার উপায় নেই। যদি বা কোনওক্রমে রাস্তার উপর সে উঠতে পারে, সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির সারি পিছনে পিছনে চলতে শুরু করে। কখনও কখনও গাড়ি সাত-আট ফুটের মধ্যে চলে আসে।
আর আমাদের দেশে ডি এস পি থেকে রাষ্ট্রপতি সবাই ভি আই পি। যত গাড়ি ঢোকে বন বিভাগের তত লাভ। বন বিভাগ ইচ্ছা মতো প্রবেশের ফি-ও বাড়িয়ে চলেছে। ওই টাকার একটা বড় অংশ খরচ হয় বর্ষাকালের পর বনের রাস্তার উপরে জন্মানো আগাছা পরিষ্কার করে রাস্তাকে গাড়ি চালানোর উপযোগী করে তুলতে। পর্যটকদের জন্য জঙ্গলের ভিতরে ক্যান্টিন পরিষেবা (যেমন, কানহায় হয়) থেকে আরম্ভ করে জঙ্গলের ঠিক বাইরে গাইডদের জন্য কংক্রিটের বিশ্রামগৃহ তৈরি, প্রকল্পের ঠিক প্রবেশ দ্বারের বাইরে বাচ্চাদের বিনোদনের ব্যবস্থা করা (যেমন বান্ধবগড়ে আছে)। প্রবেশদ্বার বা প্রবেশের সীমানার ঠিক বাইরেই পর পর হোটেল, রেস্টুর্যান্ট। পাঁচতারা হোটেলেরও অভাব নেই।
নামকরা ব্যাঘ্র প্রকল্পে আরেক অত্যাচার ‘টাইগার শো’। রোজ ভোরে হাতি নিয়ে মাহুতরা বেরিয়ে পড়ে বাঘের খোঁজে। যে কোনও একজন খোঁজ পেলে ওয়াকিটকি দিয়ে বাকি মাহুতদের জানিয়ে দেয়। আর সবক’টা হাতি এসে বাঘটাকে চার দিকে ঘিরে ধরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাঘটা বিরক্ত হয়ে বসে পড়ে। তার পর হতাশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। বাঘ দেখার জন্য পর্যটকরা অনেক আগে থেকে রেঞ্জারের খাতায় নাম লিখিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। মাহুতের কাছ থেকে খবর পৌঁছানো মাত্র গাড়ি ছুটিয়ে পর্যটকরা পৌঁছে যান। আর হাতি এসে একবারে চার জন করে পর্যটককে বাঘের কাছে নিয়ে যায়। কোনও কোনও ফোটোগ্রাফার মাহুতের হাতে দু’চার টাকা গুঁজে দেন, যাতে মাহুত এমন কিছু করে যে, ঘুমন্ত বাঘটা বিরক্তিতে নড়ে বসে বা উঠে দাঁড়ায়।
বাঘের দিক থেকে চিন্তা করলে ব্যাঘ্র প্রকল্পের কোর এলাকাতে পর্যটন বা বিনোদনের জন্য তথ্যচিত্র তোলা এই মুহূর্তে বন্ধ করে দেওয়াই উচিত। তবে পর্যটন বন্ধ করার এক বিপদও আছে। উদাহারণ দিয়ে বলা যায় যে, সিমলিপালের কোর এলাকা আপার বড়া মামরা বা দেবস্থলী পর্যটকদের জন্য আশির দশকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ওই অঞ্চলগুলিতে ঘন জঙ্গলে বন্যপ্রাণী অহরহই দেখা যেত। কিন্তু পর্যটন বন্ধ করবার বছর সাতেকের মধ্যে লোকচক্ষুর আড়ালে বন্যপ্রাণীও চোরাশিকারিদের হাতে শেষ হয়েই গেল। গাছগুলোও কেটে সাফ। কয়েক বছর আগে পর্যটকরা সুন্দরবনে মৃত বাঘকে জলে ভাসতে দেখেন এবং তাঁরাই বন দফতরে খবর দেন। জঙ্গলে কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে পর্যটকরাই সক্রিয় ভূমিকা পালন করে থাকেন। এ ছাড়া পর্যটনকে একেবারে বন্ধ করে দিলে সাধারণ মানুষকে তাদের সম্পদ দেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হবে। বহু লোকের রুটি-রুজির প্রশ্নও পর্যটন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এমন কিছু ভাবা যেতে পারে কি, যাতে পর্যটনকে বজায় রেখেও বাঘের স্বার্থ রক্ষা করা যায়?
জঙ্গলের ভিতরে ঘোরার জন্য গাড়ির সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া, সমস্ত গাড়িকে জঙ্গল কর্তৃপক্ষের কাছে নথিভুক্ত করা সম্ভব। ভি আই পি-দেরও জঙ্গলে ঢুকতে হলে নথিভুক্ত গাড়িতেই যেতে হবে। শুধু তাই নয়, বাঘের যাতায়াতের রাস্তায় কোনও গাড়ি বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না বা বাঘের দেখা পেলে কমপক্ষে পঞ্চাশ মিটার দূরে গাড়ি দাঁড়াতে হবে। পিছন পিছন গাড়ি নিয়ে ধাওয়া করা যাবে না, অন্তত পঞ্চাশ মিটার দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। বাঘের বাচ্চা প্রসবের সময় এলাকাটি তিন মাসের জন্য পর্যটকদের কাছে বন্ধ করে দেওয়া প্রয়োজন। হোটেল বা রেস্টুর্যান্টগুলিকে এক কিলোমিটার বাইরে সরিয়ে দেওয়া দরকার, যাতে মানুষের বা গাড়ির শব্দ জঙ্গলের ভিতর ঢুকতে না-পারে। এইটুকু বোধ হয় করাই যায়। |