দীর্ঘায়ু হইতে কে না চায়? শুভাকাঙ্ক্ষীরাও স্নেহাস্পদের শতায়ু কামনা করিয়া আশীর্বাদ করিয়া থাকেন। সুপক্ব গোধূমের ন্যায়, গোধূলির স্বর্ণচ্ছটার ন্যায়, আনন্দোজ্জ্বল বার্ধক্য জীবনের পূর্ণতা নির্দেশ করে। কিন্তু গোটা মানবজাতির আয়ু দীর্ঘ হইয়া উঠিতেছে, সেই সংবাদ কিছু উদ্বেগেরও জন্ম দেয়। সম্প্রতি রাষ্ট্রপুঞ্জ জনসংখ্যা বিষয়ে নূতন পরিসংখ্যান প্রকাশ করিয়াছে। দেখা যাইতেছে, বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির যে ধারা দেখা যাইতেছে, তাহাতে ২০৫০ সালে বিশ্বে দুশো কোটি ষাটোর্ধ্ব মানুষ থাকিবার কথা। তাঁহারাই হইবেন জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ। শতায়ুর সংখ্যাও দশগুণ বাড়িবে। অর্থনীতিতে উন্নত দেশগুলিতে জন্মহার কমিতেছে, মোট জনসংখ্যাও কমিতেছে। সেখানে জনসংখ্যায় বৃদ্ধদের অনুপাত বাড়িবে। কিন্তু বৃদ্ধদের মোট সংখ্যায় বৃদ্ধির অধিকাংশ হইবে তুলনায় অনুন্নত দেশগুলিতেই। ভারতেই গত ১০ বছরে নাগরিকদের গড় আয়ু বাড়িয়াছে সাড়ে চার বৎসর। ঔষধ, চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির সহিত আয়ু আরও বাড়িবে, ইহাই প্রত্যাশিত। তুলনায় কর্মক্ষম মানুষের অনুপাত কমিতেছে প্রায় সর্বত্র। এখন বিশ্বে প্রতি বৃদ্ধের দায়িত্ব লইতে রহিয়াছেন নয় জন কর্মক্ষম মানুষ, ২০৫০ সালে সংখ্যাটি দাঁড়াইবে পাঁচ।
অতএব সমাজের সম্মুখে নূতন নূতন পরীক্ষা উপস্থিত হইতেছে। কী করিয়া বৃদ্ধ মানুষদের সামাজিক নিরাপত্তার জোগান দেওয়া যায়, ইহা একটি পরীক্ষা। এই মুহূর্তে ভারতীয় রেলে যত কর্মী বেতন পান, তাহার অধিক কর্মী পেনশন পান। তাই কর্মীদের উৎপাদনশীলতা না বাড়াইলে যথেষ্ট কর আদায় করিয়া বৃদ্ধদের আর্থিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা সম্ভব হইবে না। দ্বিতীয়ত, ব্যয়বহুল চিকিৎসার চাহিদা বাড়িবে, কারণ উন্নয়নশীল দেশগুলিতেও ক্যান্সার, ডায়াবিটিস, হৃদরোগের ন্যায় অসংক্রামক রোগেই বৃদ্ধরা আক্রান্ত হইবেন বেশি। বর্তমানে গোটা বিশ্বে দুই-তৃতীয়াংশ মৃত্যুর কারণ অসংক্রামক নানা রোগ। এই মৃত্যুর অধিকাংশই ঘটিয়াছে দরিদ্র দুনিয়ায়। ব্যাপক এবং তৎপর চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকিলে বহু বৃদ্ধ মানুষের মানবিক অধিকার লঙ্ঘিত হইবে। তৃতীয়ত, শুধু টাকা কিংবা ওষুধ জোগাইলেই হইবে না, বৃদ্ধদের নিয়মিত দেখাশোনা করিবার লোকও প্রয়োজন। কেবল পরিবারের উপর যে এ বিষয়ে নির্ভর করা যাইবে না, তাহা স্পষ্ট। উন্নত দেশগুলিতে ‘পরিচর্যা শিল্প’ অর্থনীতির একটি বিশেষ প্রশাখা হইয়া উঠিয়াছে। ভারতে এখনও পরিচর্যার কাজটি শিল্প হিসাবে সংগঠিত হইতে পারে নাই। তাহার জন্য যে পরিকাঠামো ও শিক্ষণ প্রয়োজন, তাহা তৈরি হয় নাই। এই কাজটিও দ্রুত করিতে হইবে।
ভারতের ন্যায় দেশের অর্থনীতিতে সামাজিক ন্যায়ের জন্যই দ্রুত আয়বৃদ্ধির প্রয়োজন। পর্যাপ্ত অর্থ থাকিলে তবেই সামাজিক নিরাপত্তার প্রকল্পগুলিকে জোরদার করা সম্ভব হইবে। কিন্তু আর্থিক সহায়তা গুরুত্বপূর্ণ হইলেও, তাহাই শেষ কথা নহে। বহু বৃদ্ধের নিকট আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য অপেক্ষা সাহচর্যের প্রয়োজন বেশি। একাকিত্ব এবং নিঃসঙ্গতা এ দেশেও বৃদ্ধদের গ্রাস করিতেছে। জীবনের যে সময়টি আরাম-বিশ্রামের সময় হওয়া উচিত, বহু মানুষের জীবনে তাহা আতঙ্কে-বিষাদে পূর্ণ হয়। বৃদ্ধদের প্রতি পরিবার-পরিজনের দৈনন্দিন অবহেলা-নির্যাতন আমাদের চোখ এড়াইয়া যায়, তাঁহারা সহজে দুষ্কৃতীদেরও শিকার হইয়া পড়েন। কর্মজীবনে উপার্জনক্ষম থাকিয়াও অনেকে বার্ধক্যে দারিদ্রে পতিত হন। বহু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা অশক্ত শরীরেও গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য কাজ করিয়া যান। আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানের মধ্য দিয়া এই পরিচিত মুখগুলির সমস্যার তীব্রতাই ফুটিয়া উঠিতেছে। |