অনেকক্ষণ ধরেই মেজাজ খারাপ তুতুনের। ফেসবুক চ্যাটে বন্ধুরা হাজারো প্রশ্ন করলেও উত্তর দেওয়ার ইচ্ছা নেই। আচমকাই কম্পিউটারে ভেসে উঠল স্নেহার মেসেজ ‘মন খারাপ নাকি?’ লেখাটা চোখে পড়তেই লাফিয়ে উঠল তুতুন। এতক্ষণ সে স্নেহার কথাই ভাবছিল। কিন্তু ফোন, ফেসবুক কিছুতেই ধরা যাচ্ছিল না কলকাতা থেকে বহু দূরের ছোট্ট পাহাড়ি শহরের ওই বাসিন্দাকে।
বেশ কিছুক্ষণ দু’জনের গল্প, খুনসুটি চলল ফেসবুকে। এর ফাঁকেই কালীঘাটের সঙ্ঘশ্রীর একটি ছবিতে ‘লাইক’ করল তুতুন। দেখে স্নেহা জানতে চাইল, ‘এটা কি কোনও ক্লাব?’ তুতুন লিখল, ‘অফকোর্স। দক্ষিণ কলকাতার। ওদের মতো অনেক ক্লাবেরই ফেসবুকে অ্যাকাউন্ট আছে।’
এ বার কেমন হবে? স্নেহার প্রশ্নটা দেখেই তুতুন ঝটপট টাইপ করতে লাগল কলকাতার পুজো-প্রস্তুতির গল্প। সঙ্ঘশ্রীর ৬৭তম বর্ষের ভাবনা, “এ চিত্র, সে চিত্র, চালচিত্র”। প্রতিমার পিছনে চালচিত্রের সূত্রপাত বৌদ্ধ যুগ থেকে। সপ্তদশ শতক থেকে বাংলার দুর্গাপুজোয় চালচিত্রের ব্যবহার শুরু হয়। বাড়ির পুজোয় দেখা যেত এক চালি। সেখান থেকেই ক্রমশ তিন, পাঁচ চালির ব্যবহার শুরু। চালচিত্রের এই বিবর্তন নিয়েই এই ক্লাবের এ বারের পথ চলা।
এর পরের ক্লাবের কথা বলতে গিয়ে তুতুন বলল, ‘‘জলের বয়ে চলার মধ্যে যেমন কোনও নির্দিষ্ট পথ নেই, তেমনই ভাবনারও বয়ে চলার নির্দিষ্ট পথ নেই। মনও নিজের মতো করে আপন ছন্দে বয়ে চলে।’ তুতুন স্নেহাকে জানাল, এই ভাবনাকে কাজে লাগিয়েই মণ্ডপ সাজাচ্ছে হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের কালীঘাট মিলন সঙ্ঘ। আবার চারু অ্যাভিনিউ নবপল্লি সঙ্ঘ এ বছর দর্শনার্থীদের বাসে চাপিয়ে ঠাকুর দেখানোর ব্যবস্থা করছে। উদ্যোক্তারা জানাচ্ছেন, বাসে চেপে পৌঁছতে হবে তাঁদের মণ্ডপে। প্রতিমা দেখে আবার আলাদা বাসে ফিরতে হবে।
পুজোর প্রস্তুতির গল্প শুনতে শুনতেই স্নেহা প্রশ্ন করল ‘তোমাদের ওখানে নাকি মাঝে মধ্যেই মাটির নীচ থেকে পুরনো মূর্তি পাওয়া যায়। এটা কি ঠিক?’ তুতুনের সাফ জবাব, ‘একদম ঠিক।’ আর এই মাটির নীচ থেকে মূর্তি, স্থাপত্য উদ্ধারের বিষয়ই তো এ বার আলিপুর সর্বজনীন-এর হাতিয়ার। আলিপুর রোডের ‘শিমুলতলী গ্রামে’ মাটি খুঁড়ে প্রায় ১৪ ফুট নীচ থেকে মিলেছে এক দুর্গামূর্তি, পুরনো পাঁচিলের ধ্বংসাবশেষ ও মন্দিরের একাংশ। সেই মূর্তি নিয়েই সে গ্রামের লোকজন মেতেছেন পুজোয়। রয়েছে গ্রাম্য মেলাও।
পুরনো খোলনলচে বদলে, একঘেয়ে স্বাদ পাল্টে ৬৪ পল্লি পুজো পরিষদ-এর দুর্গোৎসব একেবারে নতুন সাজে। মণ্ডপ জুড়ে থাকবে ঢোল, করতাল, বাঁশি, হারমোনিয়াম, খোল-সহ নানা বাদ্যযন্ত্র। আবার স্বামী বিবেকানন্দের সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে তাঁকে স্মরণ করতে প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের পল্লিমঙ্গল সমিতির এ বারের নিবেদন, ‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত’। মানবসভ্যতার বিবর্তন নিয়ে মণ্ডপ সাজাচ্ছে সূর্যনগর সর্বজনীন দুর্গাপুজো কমিটি। আদিম মানুষ কী ভাবে জঙ্গল থেকে গুহা-জীবনে প্রবেশ করল, শিকার পদ্ধতি বদলাল, আগুনের ব্যবহার শিখল সবই তুলে ধরা হবে মণ্ডপে। ‘কী বুঝলে? কলকাতার পুজো কত জমজমাট!’ তুতুনের এই মন্তব্য দেখেই স্নেহা লিখল, ‘তাই তো এ বার পুজোয় কলকাতা আসছি। খুশি তো?’ |