|
|
|
|
লোভের টোপে লোপাট সঞ্চয়, সাবধান করল কেন্দ্র |
জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায় • কলকাতা |
বাড়ি, গাড়ি, সোনা, বিপুল সুদ-সহ নানান লোভনীয় ফেরতের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজ্যে রাজ্যে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা তোলে বহু সংস্থা। কোনও আইনি অনুমোদন ছাড়াই। এদের বিরুদ্ধে রাজ্যগুলিকে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যবস্থা নিতে বলল কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রক।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রকের আর্থিক পরিষেবা বিভাগ থেকে পাঠানো এক নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, গরিব মানুষকে নিঃস্ব হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে রাজ্য সরকারকে আইন করে এই সব কাজকর্মের মোকাবিলা করতে হবে। আইন তৈরি সময়সাপেক্ষ, তাই এখনই ব্যবস্থা নিতে প্রত্যেক রাজ্যকে নজরদার কমিটি গড়ার পরামর্শ দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার।
কেন্দ্রের এই পরামর্শ মহাকরণে অর্থ দফতরে এসেছে আড়াই মাস আগে। কিন্তু তার পরেও সেখানে এই নজরদার কমিটি নিয়ে তৎপরতা নেই বলেই সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর। দফতরের এক কর্তার বক্তব্য, কেন্দ্র তো এমন কত চিঠিই দিয়ে থাকে। সব চিঠির গুরুত্ব কি সমান?
অর্থ দফতর সূত্রের খবর, গত ২৪ জুলাই মন্ত্রকের আর্থিক পরিষেবা (ডিপার্টমেন্ট অফ ফাইনান্সিয়াল সার্ভিস) বিভাগের যুগ্ম-সচিব অলোক নিগম সমস্ত রাজ্যকে এ ব্যাপারে একটি নির্দেশিকা পাঠান। তাতে তিনি লিখেছেন, বিভিন্ন রাজ্য থেকে ‘টাকা তোলা’ সংস্থাগুলির একাংশ সম্পর্কে নানা ধরনের খবর আসছে। সংস্থাগুলি মূলত পিরামিড এবং পন্জি মডেলে বাজার থেকে কোটি কোটি টাকা তুলছে। বহু সাধারণ মানুষ এর ফলে প্রতারিত হচ্ছেন। বেশ কয়েকটি রাজ্য ইতিমধ্যেই কিছু সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে। কেন্দ্র এখন চাইছে, রাজ্যগুলি নিজেরাই পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইন তৈরি করুক। আপাতত যে সব অভিযোগ উঠছে, তা খতিয়ে দেখতে প্রতি রাজ্যে নজরদার কমিটি গড়া হোক। |
পন্জি স্কিম
ভাবনার উৎস চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাস ‘মার্টিন শাজলউইট’ (১৮৪৪) এবং ‘লিটল ডোরিট’ (১৮৫৭)! বিশ শতকের কুড়ির দশকে বাস্তবে প্রয়োগ করে জেলে যান মার্কিন ব্যবসায়ী চার্লস পন্জি। স্কিমটা কী? মোটা অঙ্ক ফেরতের প্রতিশ্রুতি দিয়ে টাকা তোলা। নতুন লগ্নিকারীদের অর্থে পুরনোদের টাকা মেটানো। বিশ্বের কোথাও সফল হয়নি। |
|
নজরদার কমিটিতে কারা থাকবেন, তা-ও বলে দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রের ওই নির্দেশিকাটিতে। ওই যুগ্ম-সচিব লিখেছেন, কমিটিতে বাধ্যতামূলক ভাবে পুলিশ, সিআইডি, গোয়েন্দা দফতর, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, সেবি, কোম্পানি বিষয়ক মন্ত্রকের প্রতিনিধি, কোম্পানি নিবন্ধীকরণ (রেজিস্ট্রেশন) সংক্রান্ত বিভাগের প্রতিনিধিদের রাখতে হবে। টাকা তোলা সংস্থাগুলির একটা বড় অংশ, যারা বেআইনি কাজকর্ম চালাচ্ছে, তাদের সম্পর্কে খোঁজখবর পেলেই নজরদার কমিটি তা খতিয়ে দেখে উপযুক্ত আইনি পদক্ষেপ করবে। প্রতি মাসে পর্যালোচনা বৈঠকে বসে কমিটি এই ধরনের সংস্থাগুলির উপর ধারাবাহিক নজরদারি চালাবে।
কেন্দ্রের এই পরামর্শে রাজ্যের প্রতিক্রিয়া কী? অর্থ দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “পশ্চিমবঙ্গ অনেক আগেই এ ব্যাপারে আইন প্রণয়ন করেছে। তা রাষ্ট্রপতির সম্মতির জন্য পাঠানো হয়েছে। এখনও ফেরত আসেনি। তবে আলাদা করে নজরদার কমিটি গঠনের ব্যাপারে আমাদের তেমন উৎসাহ নেই। ব্যবস্থা তো দিল্লিই নিতে পারে।” ওই কর্তার মতে, টাকা তোলা সংস্থাগুলির একটা অংশ যে গ্রামে-গঞ্জে বহু গরিব মানুষকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এরা কেউই সরাসরি ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পের নামে টাকা তুলছে না। তা করলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক কিংবা সিকিওরিটি এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া (সেবি) এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। এরা মোটা অঙ্কের টাকা ফেরতের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ‘প্রোডাক্ট লিঙ্কড’ পলিসি বিক্রি করছে। যা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বা সেবি অনুমোদিত নয়। এই পলিসিগুলিতে টাকার বদলে বিপুল ফেরত ছাড়াও জমি, ফ্ল্যাট, সোনা, বেড়াতে যাওয়ার খরচ, হোটেল ভাড়া, এমনকী মেহগনি গাছ, এমু পাখি, সাদা শুয়োর কিনে ব্যবসার প্রতিশ্রুতি পর্যন্ত দেয়। বিনিয়োগকারীরা সরল বিশ্বাসে এদের কাছে টাকা রাখেন। এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট অভিযোগ না এলে আইনি পদক্ষেপ করা সমস্যার। |
পিরামিড মডেল
|
অভাবনীয় অঙ্ক ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে টাকা তোলা। ‘নিউ মানি’ বা নতুন লগ্নির
অভাব
হলে এক দিন হঠাৎ হাওয়ায় উবে যাওয়া।
মালিককে খুঁজে পাওয়া যায় না কখনও।
পড়ে থাকেন এজেন্টরা। পিরামিড মডেল দ্রুত ধসে। তার বিস্তারই তার ধ্বংসের কারণ।
* ভারতের জনসংখ্যা ছাপিয়ে যাবে |
কেন তেমন অভিযোগ আসছে না? ওই কর্তার ব্যাখ্যা, এই ধরনের সংস্থায় যাঁরা টাকা রাখেন, তাঁদের অনেকেই বহু ক্ষেত্রে ততটা সচেতন নন। পুঁজির পরিমাণও সামান্য। ফলে আর্থিক ক্ষতি হলেও অভিযোগ জানানোর ব্যাপারে ততটা তৎপর হন না। আর যখন পরপর অভিযোগ আসতে থাকে, তখন দেখা যায়, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই সংস্থাটি যেন রাতারাতি উবে গিয়েছে। পন্জি বা পিরামিড মডেলের এটাই রহস্য। তবে দু’একটি ঘটনায় পুলিশ ব্যবস্থা নিতে পেরেছে।
এ রাজ্যে টাকা তোলা সংস্থাগুলির ব্যবসা বাড়ায় সরকারি সঞ্চয় প্রকল্পগুলির হাল খারাপ হয়েছে বলেও মনে করছে অর্থ দফতর। তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১১-১২ সালের আর্থিক সমীক্ষা বলছে, ২০১০-১১ সালে ডাকঘরে ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পে এ রাজ্যে ৮৪০৯ কোটি ৪৫ লক্ষ টাকা জমা হয়েছিল। ২০১১-১২ সালের এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সাত মাসে জমা হয়েছে মাত্র ১৯৪ কোটি টাকা! অথচ ডাকঘরে জমানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮৩৭০ কোটি টাকা। অর্থ দফতরের কর্তাদের মতে, গ্রামের মানুষ আর ডাকঘরে টাকা রাখতে চাইছেন না। টাকা তোলা সংস্থাগুলির কথায় প্রভাবিত হয়ে তাদের কাছেই টাকা জমাচ্ছেন বহু গরিব মানুষ। ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্প মার খাওয়ার সেটা একটা বড় কারণ।
শুধু সরকারি সঞ্চয় প্রকল্প নয়, এই সব সংস্থার কাছে ধাক্কা খেয়েছে কয়েকটি রাজ্যের ব্যাঙ্কগুলির ব্যবসাও। গত ২৫ সেপ্টেম্বর স্টেট লেভেল ব্যাঙ্কার্স কমিটির বৈঠকে এই প্রসঙ্গটিও আলোচনার জন্য ওঠে। ব্যাঙ্কার্স কমিটির সে দিনের ওই বৈঠকে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রও উপস্থিত ছিলেন। টাকা তোলা সংস্থাগুলির দাপটে কী ভাবে তাদের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের প্রতিনিধিরা। প্রতিনিধিদের বক্তব্য, গ্রামীণ এলাকায় ব্যাঙ্কের একটি শাখা থাকলেও বহু টাকা তোলা সংস্থা অসংখ্য অফিস খুলেছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সংস্থাগুলির প্রতিনিধিরা টাকা তুলে নিয়ে আসছেন। অন্যান্য লোভনীয় প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি টাকা জমা করার ব্যাপারে এই বিষয়টিকে বাড়তি সুবিধা হিসেবে ধরে নিয়ে বহু লোক ব্যাঙ্কের বদলে ওই সব সংস্থায় টাকা রাখছেন বলে জানিয়েছেন তাঁরা। এই পরিস্থিতিটাই উদ্বেগ বাড়িয়েছে কেন্দ্রের। টাকা তোলা সংস্থাগুলির ব্যাপারে তাই রাজ্যগুলিকে সতর্ক করার পাশাপাশি তাদের রাশ টানতে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে তারা। |
|
|
|
|
|