শিল্পপার্কের বিজ্ঞাপনেও লগ্নিতে সেই সাড়া কই
রাজারহাটের অর্থতালুক, কলকাতার কর্পোরেট বাস প্রকল্পের পরে এ বার শিল্পোন্নয়ন নিগমের শিল্পপার্ক।
রাজ্য সরকারের আহ্বানের প্রতি বিনিয়োগকারীদের ‘উদাসীনতার’ ধারা কার্যত অব্যাহত। তিনটি শিল্পপার্কের অধিগৃহীত জমিতে শিল্প স্থাপনের প্রস্তাব চেয়ে নিগম যে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল, সময়সীমা অতিক্রমের পরে দেখা যাচ্ছে, সাড়া দিয়েছে নামমাত্র কয়েকটি সংস্থা। লগ্নিকারীদের হাতে তুলে দিতে চাওয়া জমির ৯৫ শতাংশের জন্যই রাজ্য খরিদ্দার পায়নি!
এই ঘটনায় তিনটি শিল্পপার্কের ভবিষ্যৎ যেমন কিছুটা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে, তেমন ফের প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে পশ্চিমবঙ্গের দেড় বছর বয়সী নতুন সরকারের ‘শিল্পবন্ধু ভাবমূর্তি।’ এর আগে পর্যটনে লগ্নিতে আগ্রহীদের থেকে আবেদনপত্র চেয়ে তেমন সাড়া পায়নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। কলকাতায় কর্পোরেট বাস চালানোর ডাক দিয়ে হতাশ হতে হয়েছে পরিবহণ দফতরকে। আবার রাজারহাটের নিউটাউনে অর্থতালুক (ফিনান্সিয়াল হাব) প্রকল্পে বিনিয়োগ চেয়ে তিন-তিন বার বিজ্ঞাপন দিয়ে হিডকো বিশেষ সাড়া পায়নি।
শিল্পপার্কে লগ্নি নিয়ে রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগম (ডব্লিউবিআইডিসি)-এর অভিজ্ঞতা এই ‘ব্যর্থতা’র তালিকায় নবতম সংযোজন। পশ্চিম মেদিনীপুরের খড়্গপুর, উত্তর ২৪ পরগনার নৈহাটি এবং বর্ধমানের পানাগড়ে ওই তিনটি শিল্পপার্কের মোট প্রায় ১২৫০ একর অব্যবহৃত জমি আগ্রহী শিল্পোদ্যোগীদের হাতে ৯৯ বছরের লিজ-ভিত্তিতে তুলে দিতে চেয়ে গত ২৫ জুলাই সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল ডব্লিউবিআইডিসি। আবেদন জমার শেষ তারিখ প্রথমে ছিল ৩১ অগস্ট, পরে তা বাড়িয়ে করা হয় ৩০ সেপ্টেম্বর। এর মধ্যে যে ক’টা আবেদন এসেছে, তাতে জমির চাহিদা ৫০ একরও ছাড়াবে না বলে সরকারি সূত্রের খবর।
উদ্যোগে আহ্বান
কোথায় কত জমিতে* ধার্য দাম**
বিদ্যাসাগর পার্ক (খড়্গপুর) ৫০৭.৬৬ ৪৩ লক্ষ
পানাগড় শিল্পপার্ক (বর্ধমান) ৬৬০ ৪০ লক্ষ
ঋষি বঙ্কিম শিল্পোদ্যান (নৈহাটি) ৭৭.৮২ ৭৫ লক্ষ
*পরিমাণ একরে ** একর পিছু, টাকায়
শিল্পপার্কগুলোর জন্য নিগম জমি অধিগ্রহণ করেছিল বাম আমলে। খড়্গপুরের পার্কে অধিগৃহীত মোট ১১৫০ একরের ৫৪০ একর ইতিমধ্যে কিছু সংস্থাকে লিজ দেওয়া হয়েছে। তালিকায় টেলকনের মতো সংস্থাও রয়েছে। পানাগড়ের মোট ১৪৫৮ একরের মধ্যে ম্যাটিক্স ফার্টিলাইজার নিয়েছে ৫০০ একর, আর এক সংস্থা ৬৫ একর। নৈহাটিতে প্রায় ১৯ একর ইতিমধ্যে কিছু সংস্থা লিজে নিয়েছে। শিল্প দফতরের খবর, তিনটি পার্কে এ পর্যন্ত যত জমি বরাদ্দ হয়েছে, তার সিংহভাগ দেওয়া হয়েছে বাম জমানায়। জুলাইয়ে বিজ্ঞাপন দেওয়ার আগে, নতুন সরকারের আমলেও শিল্পপার্কে বিনিয়োগের কয়েকটি আবেদন এসেছে। যেমন পানাগড়ে মারুতির লজিস্টিক হাব (৩৪ একর), তাঁতিয়া কনস্ট্রাকশন (১৫ একর), হিন্দুস্থান ন্যাশনাল গ্লাস (১৭০ একর), হিন্দুস্থান পেট্রোলিয়াম (৩০ একর)। তবে সব মিলিয়ে মজুত জমির তুলনায় চাহিদা নিতান্তই নগণ্য।
পশ্চিমবঙ্গের শিল্পপার্কে শিল্প স্থাপনে লগ্নিকারীদের এ হেন ‘অনাগ্রহ’ দেখে সরকারি কর্তাদের অনেকে উদ্বিগ্ন। শিল্প দফতরের একাংশের মতে, পশ্চিমবঙ্গের শিল্প-ভাবমূর্তি যে এখনও অনুজ্জ্বল, পর্যটন-কর্পোরেট বাস-অর্থতালুকের পরে শিল্পপার্কের ঘটনা তারই প্রমাণ। “তিনটে পার্কের ভৌগোলিক অবস্থান শিল্প গঠনের উপযোগী। উপরন্তু পার্কের মধ্যে রাস্তা-বিদ্যুৎ-জল-নিকাশির মতো পরিকাঠামো নিগমই বানিয়ে দেবে। তা সত্ত্বেও ওখানে জমি চেয়ে আবেদন না-আসাটা যথেষ্ট চিন্তার।” বলেন সরকারি এক কর্তা। রাজ্য সরকারের কী ব্যাখ্যা?
শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য হতাশার বিশেষ কারণ দেখছেন না। তাঁর ব্যাখ্যা, ঠিকমতো প্রচার হয়নি বলেই আবেদন কম এসেছে। মন্ত্রীর কথায়, “শুধু বিজ্ঞাপন দিয়ে বিনিয়োগ চাইলে হবে না। ওয়েবসাইটেও সব কিছু জানাতে হবে।” বস্তুত রাজ্যের শিল্পমহলের একটি অংশও মনে করছে, লগ্নি টানতে হলে ঠিকঠাক তথ্য জোগানোয় সরকারকে আরও নজর দিতে হবে। বণিকসভা মার্চেন্ট চেম্বার অফ কমার্সের সভাপতি অশোক জালান যেমন বলেন, “সরকারের তরফে এমন প্রস্তাব যে দেওয়া হয়েছে, সেটাই অনেকে জানতেন না! আমিও না। তা ছাড়া জমির দাম নিয়েও তো প্রশ্ন থাকতে পারে!” অ্যাসোচ্যামের পূর্বাঞ্চলীয় কো-চেয়ারম্যান এসএন নন্দীর মন্তব্য, “পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের সম্ভাবনা আছে, সম্পদেরও অভাব নেই। কিন্তু বিনিয়োগের জন্য শুধু একটা বিজ্ঞাপন দিলেই হবে না। বণিকমহলকে জানাতে হবে, কোথায় কী সুবিধা আছে।”
রাজ্য সরকারের তরফে ‘তৎপরতার’ এই ঘাটতি কি শিল্প-ভাবমূর্তিতে ছায়া ফেলছে?
শিল্পমন্ত্রী এমনটা মানতে নারাজ। বরং তাঁর দাবি, শিল্পপার্ক নিয়ে তাঁদের উদ্যোগে রাজ্যের শিল্প-ভাবমূর্তি উজ্জ্বলই হবে। “অনেকে অভিযোগ করেন, বিনিয়োগ করতে চেয়েও নাকি জমি পাচ্ছেন না! আমি বার বার বলেছি, জমির কোনও সমস্যা নেই। শিল্পপার্কে সেটাই প্রমাণ হল।” বলেন পার্থবাবু। যদিও শিল্পমহলের পাল্টা দাবি, প্লটভিত্তিক শিল্পপার্কে একলপ্তে বেশি জমি মিলবে না, বড় শিল্পের জন্য যা একান্ত প্রয়োজন। রাজ্য সরকার তার সংস্থান করতে পারবে কি না, সে প্রশ্নও তুলেছে শিল্পমহলের একটি অংশ। এদের বক্তব্য, “রাজ্য সরকার বলছে, বেসরকারি ও যৌথ প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ করবে না। তা হলে বড় শিল্পের জমি কী ভাবে জোগাড় হবে, তা স্পষ্ট নয়। বাস্তব অবস্থা বিবেচনা করে রাজ্যকেই পথ বার করতে হবে।”
এবং এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দিক থেকে যত দিন না পর্যন্ত সুস্পষ্ট দিশা-নির্দেশ পাওয়া যায়, তত দিন রাজ্যের লগ্নি-প্রস্তাবে আগ্রহের অভাব ঘটতেই থাকবে বলে শিল্প-বণিকমহলের অন্দরে আশঙ্কা দানা বেঁধেছে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.