সেতুতে ওঠার আগে রাস্তা বেঁকে গিয়েছে প্রায় ৯০ ডিগ্রি। সেতু থেকে নামার পরেই আবার প্রায় সমকোণে বাঁক। রাস্তার দু’পাশই ঢালু। রাতে জ্বলে না কোনও আলো। দ্রুত গতিতে গাড়ি নিয়ে সেতুতে উঠে নিয়ন্ত্রণ হারালেই বিপদ অনিবার্য। আর তা-ই বারবার ঘটছে জামালপুরের চৌবেড়িয়া সেতুতে।
সোমবার রাতেই বিপজ্জনক এই পথের বলি হয়েছেন দশ জন। হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন আরও কয়েক জন। এই সেতুতে এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা প্রথম নয়। এর আগে বড় দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল চার বছর আগে দুর্গাপুজোর সপ্তমিতে। দশ জন যাত্রী নিয়ে সেতু থেকে গড়িয়ে পড়েছিল একটি বড় গাড়ি। মৃত্যু হয়েছিল স্থানীয় পাঁচড়া গ্রামের রক্ষিত পরিবারের দশ জনেরই। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সে বার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার বাঁকের ডান দিকে গড়িয়ে গাড়িটি সরাসরি পড়েছিল সেচখালের জলে। এ বার অবশ্য সেতু সংলগ্ন রাস্তা থেকে মিনি ট্রাকটি বাঁ দিকে গড়িয়ে পড়ে আছাড় খায় শক্ত মাটিতে। একটি দোকান না থাকলে এই ট্রাকটিও খালের জলে গিয়ে পড়ত বলেই অনুমান বাসিন্দাদের। সে ক্ষেত্রে আরও বেশি প্রাণহানির আশঙ্কা ছিল বলে তাঁদের ধারণা। |
পরপর দুর্ঘটনায় ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী। স্থানীয় বাসিন্দা ভবসিন্ধু বালার কথায়, “জামালপুর-মেমারি রোডে এই চৌবেড়িয়া সেতুর কাছে রাস্তা বরাবরই বিপজ্জনক। দু’দিকেই রয়েছে বিশাল ঢাল। তার উপরে রাস্তায় আলো নেই। প্রতি দিনই ভয়ে থাকি।” বাসিন্দারা জানান, আলো না থাকায় এই চৌবেড়িয়া রাতে ছিনতাইবাজদের স্বর্গরাজ্য। মহিলারা রাতে এই সেতু পার হওয়ার সময়ে আতঙ্কে ভোগেন।
সোমবার রাতের দুর্ঘটনার পরে এলাকার সকলেরই চোখে ভেসে উঠেছে চার বছর আগের পুজোর সেই রাতের কথা। রক্ষিত পরিবারে এখন শ্মশানের নিস্তব্ধতা। ওই পরিবারের এক সদস্য দিলীপ রক্ষিত মঙ্গলবার বলেন, “আবার একই রকম দুর্ঘটনা দেখে মর্মাহত। কেন যে বারবার একই জায়গায় এমন দুর্ঘটনা ঘটছে, তা নিয়ে আমরা চিন্তিত। এই বাঁক যে কত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিল!” তাঁদের আত্মীয় আশুতোষ পালের কথায়, “আমার বোনের শ্বশুরবাড়ির সকলেই মারা গিয়েছিলেন সেই সপ্তমীর রাতে। ভেবেছিলাম, এমন আর হবে না। এখন তো দেখছি, পরপর দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে।”
প্রশাসনের কিন্তু টনক নড়েনি। সেতু লাগায়ো দু’পাশের রাস্তা রয়ে গিয়েছে একই রকম বিপজ্জনক। জামালপুরের তৃণমূল বিধায়ক উজ্জল প্রামাণিক বলেন, “সেতুর দু’পাশে ইংরেজির ইউ অক্ষরের মতো বাঁকের জন্যই পরপর দুর্ঘটনা। কী ভাবে এই রাস্তা নিরাপদ করা সম্ভব সে নিয়ে পুলিশের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা শুরু করেছি।” তিনি জানান, আপতত ঠিক হয়েছে, ওই রাস্তার বাঁকের চার দিকে ১০০ মিটার করে ঢালাই করে রেলিং দেওয়া হবে। পরপর কয়েকটি হাম্প থাকবে। বিপজ্জনক বাঁকের কথা জানিয়ে সাইনবোর্ড দেওয়া হবে দু’দিকেই। এ জন্য প্রয়োজনে নিজের তহবিল থেকে অর্থ দেওয়ার কথাও জানান বিধায়ক। |
বর্ধমানের জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনা অবশ্য মানতে চাননি, বাঁকের কারণেই দুর্ঘটনা ঘটেছে। তিনি বলেন, “চালক নিয়ন্ত্রণ হারানোয় এমন ঘটেছে। খবর পাওয়া মাত্র অতিরিক্ত জেলাশাসক শরৎ দ্বিবেদী ঘটনাস্থলে যান। ফের কেন দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা খতিয়ে দেখা হবে।” এর আগে গুড়াপে একটি তীর্থযাত্রী বোঝাই বাস উল্টে সাত জন মৃতের দেহ ময়না-তদন্তের পরে আত্মীয়দের হাতে তুলে দিতে গভীর রাত হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে সেই সমস্যা এড়াতে অতিরিক্ত জেলাশাসকদের বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ মর্গে ময়না-তদন্তের তদারকির জন্য মোতায়েন করা হয়েছিল।
বর্ধমানে হাসপাতালে ভর্তি আহতদের আত্মীয়েরা ঠিক মতো চিকিৎসা না মেলার অভিযোগ করেছেন। শঙ্কর মোহালি, রামোশ্বের মান্ডিদের দাবি, “কারও ক্ষতস্থান সেলাই করেই ফেলে রাখা হয়েছে। বারবার বলা সত্ত্বেও কারও এক্স-রে হচ্ছে না।” হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য কোনও রকম গাফিলতির কথা মানতে চাননি। জেলাশাসক বলেন, “আহতদের চিকিৎসার যাতে কোনও ত্রুটি না হয়, সেদিকে নজর রাখতেও বলা হয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে।”
|
মঙ্গলবার ছবিগুলি তুলেছেন উদিত সিংহ। |