সাত মাসে ছবিটা যেন অনেকটাই বদলে গেল!
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি সিপিএমের ডাকে আয়োজিত ব্রিগেড সমাবেশে বেসরকারি বাস এসেছিল হাতে গোনা। “বাস ইউনিয়নগুলো হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে যে!” আক্ষেপ শোনা গিয়েছিল সিপিএমের দাপুটে নেতাদের মুখে।
বাস-শ্রমিকদের পাশাপাশি বাস-মালিকেরাও ‘পরিবর্তনের হাওয়ায় গা ভাসানোয়’ ফেব্রুয়ারির ওই সমাবেশে কার্যত বাই পায়নি সিপিএম। সে বার তাই কর্মী-সমর্থকদের প্রতি নেতাদের আহ্বান ছিল, ‘পায়ে হেঁটে ব্রিগেড চলুন।’ কিন্তু প্রায় সাত মাস বাদে, অক্টোবরের প্রথম দিনে ফের সিপিএমের সমাবেশে
দেখা গেল, সেই মালিকদেরই ‘দাক্ষিণ্যে’ দলের বাস-ভাগ্য আবার খুলে গিয়েছে! যে উল্টোমুখো পরিবর্তনের পিছনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের বাসভাড়া না-বাড়ানোর নীতিরই মুখ্য ভূমিকা দেখছেন রাজনৈতিক-প্রশাসনিক মহলের অনেকে।
ফেব্রুয়ারিতে ব্রিগেডের সমাবেশ ছিল গোটা রাজ্যের। এ দিন রানি রাসমণি রোডে সমাবেশ ডেকেছিল সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা কমিটি। জেলার সিটু নেতা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের দাবি, “অনেক বাস-মালিক এ বার স্বেচ্ছায় বাস দিয়েছেন।” আর জেলার সিপিএম নেতা অমিতাভ নন্দীর সগর্ব ঘোষণা, “নিশ্চিন্তে লিখে দিতে পারেন, সভায় এক হাজারেরও বেশি বাস এসেছিল।” |
সিপিএমের সমাবেশে সমর্থক নিয়ে এসেছে বাস। সোমবার। ছবি: সুদীপ আচার্য। |
বস্তুত এ দিন সকাল এগারোটার পর থেকে ভিআইপি রোডে চোখে পড়েছে শ’য়ে শ’য়ে বেসরকারি বাসের ঢল। যাত্রী নয়, লাল পতাকা-শালুতে মোড়া বাসগুলো বোঝাই ছিল সিপিএম সমর্থকের ভিড়ে। গন্তব্য, ধর্মতলা। ভিতর থেকে ক্রমাগত ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান। ভরভরন্ত তৃণমূল জমানায় সিপিএমের স্রেফ একটা জেলা সমাবেশে বেসরকারি বাসের এ হেন ‘গণমিছিল’ দেখে আমজনতাও কিছুটা বিস্মিত। কী করে উলটপুরাণ হল?
উত্তর দিয়েছেন বাস-মালিক সংগঠন ‘বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেট’-এর এক নেতা। তাঁর দাবি, “ডিজেলের দাম বাড়ার পরে বাসভাড়া বাড়বে এটাই স্বাভাবিক ছিল। অথচ ভোট-প্রতিশ্রুতি রক্ষার নামে নতুন সরকার তাতে রাজি নয়! ফলে পরিবহণ-শিল্পে যেমন অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে, তেমন ক্ষোভেরও সৃষ্টি হয়েছে।” তিনি বলেন, “ভাড়া বাড়লে বাস-শ্রমিকদের আয় বাড়ত। তা হয়নি বলে ওঁরা ক্ষুব্ধ। বিরোধীদল তার সুযোগ নিয়েছে। অবস্থা বুঝে মালিকেরাও বাধা দেননি।”
সিন্ডিকেটের দাবি, মালিক-শ্রমিকের এই একমুখী মনোভাবেরই যৌথ প্রতিফলন এ দিন দেখা গিয়েছে মহানগরের পথে পথে। আগের আমলে লালঝান্ডার সভা থাকলে যেমন বিভিন্ন রুট থেকে বাস উধাও হয়ে যেত, মানুষ ভোগান্তিতে পড়তেন, এ দিনও ছবিটা প্রায় তা-ই। সিন্ডিকেটের ওই নেতা জানিয়েছেন, এ দিন খড়দহ, পানিহাটি, সোদপুর, ব্যারাকপুর, বনগাঁ, হাবরা, বারাসত, বাগুইআটি, এয়ারপোর্ট-সহ উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন রুটের বাস সিপিএমের কর্মী-সমর্থক নিয়ে ধর্মতলায় গিয়েছে। সিপিএমের এক নেতার কথায়, “শিয়ালদহ স্টেশন থেকে আমাদের একটা বিশাল মিছিল সমাবেশস্থলে গিয়েছে। বাকিদের অধিকাংশ এসেছে বাসে চড়ে। অর্থাৎ যত লোক পায়ে হেঁটেছে, তার বেশি এসেছে বাসে।” অমিতাভবাবুর মন্তব্য, “আমাদের টার্গেট ছিল পাঁচ হাজার বাস নামানোর। শেষ পর্যন্ত কত এসেছে, এখনই বলতে পারছি না। তবে সংখ্যাটা এক হাজারের অনেক বেশি তো হবেই।”
প্রশাসনের হিসেব কী?
কলকাতা পুলিশের অবশ্য দাবি, বাস এসেছিল শ’চারেক। তবে রাসমণি রোডের সিপিএম সমাবেশে বেসরকারি বাসের ‘দেদার উপস্থিতি’র কথা মেনে নিয়েছেন রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। যদিও তাঁর অভিযোগ, “সিপিএম ডান্ডা মেরে বাস নিয়ে গিয়েছে। আমার বিধানসভা-এলাকা কামারহাটিতে কয়েকশো মানুষ এই জুলুমের প্রতিবাদে বিক্ষোভ পর্যন্ত দেখিয়েছেন।”
ভাড়াবৃদ্ধি নিয়ে সরকারের ‘সিদ্ধান্তহীনতা’য় ক্ষুব্ধ বাস-মালিকেরা কিন্তু সিপিএমের সভায় বদান্যতা দেখিয়েই ক্ষান্ত থাকছেন না। সরকারের উপরে চাপ বাড়াতে তাঁদের সংগঠন ‘জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেটস’ ৯ অক্টোবর থেকে রাজ্য জুড়ে লাগাতার বাস ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। ধর্মঘট সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর কঠোর মনোভাবকে কার্যত উপেক্ষা করেই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সাধন দাস এ দিন বলেন, “ভাড়াবৃদ্ধি-সহ আমাদের বিভিন্ন দাবি বিবেচনার ব্যাপারে সরকারি আশ্বাস পেতে পেতে আমরা ক্লান্ত। আর অপেক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না।” কাউন্সিলের যুগ্ম সম্পাদক তপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণা, “৮ তারিখে যদি সরকার ভাড়াবৃদ্ধির কথা ঘোষণা করে, শুধু তা হলেই আমরা ধর্মঘটের পথ থেকে সরব।” ভাড়াবৃদ্ধির দাবিতে বেঙ্গল ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশন-সহ ছ’টি ট্যাক্সি সংগঠনও এ দিন ধমর্ঘটে নামছে।
বেঙ্গল বাস সিন্ডিকেট অবশ্য এখনই ওই ধর্মঘটে সামিল হচ্ছে না। সংগঠনের সহ সভাপতি দীপক সরকার বলেন, “দেওয়ালে আমাদের পিঠ ঠেকে গিয়েছে ঠিকই। কিন্তু ৮ তারিখ পরিবহণমন্ত্রী বৈঠক ডেকেছেন। তার আগে মন্ত্রিসভার বৈঠক রয়েছে। আমরা তাই কিছু দিন ধর্মঘট থেকে সরে থাকতে চাইছি।” ৯ তারিখের প্রস্তাবিত ধর্মঘটে সামিল হবেন কি না, সে বিষয়ে স্পষ্ট উত্তর এড়িয়ে গিয়েছেন মিনিবাস কো-অর্ডিনেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক অবশেষ দা। “আমরা বাস-মিনিবাস-ট্যাক্সিমালিকেরা বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ রাখছি। ক’দিন অপেক্ষা করে সিদ্ধান্ত নেব।” বলেন তিনি।
এই পরিস্থিতিতে সরকারের কী বক্তব্য?
পরিবহণমন্ত্রী মদনবাবু বলছেন, “৯ তারিখের তো অনেক দেরি। তবে আন্দোলন করে ভাড়া বাড়ানো যাবে না।” তাঁর অভিযোগ, “গোটা ব্যাপারটার পিছনে সিপিএম এবং কংগ্রেসের চক্রান্ত রয়েছে।” |