মুক্ত অর্থনীতির পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে আর একটি কর্মনাশা বন্ধের হুমকিকেই আঁকড়ে ধরলেন রাজ্য কংগ্রেস নেতৃত্ব। মমতার পাড়া হাজরায় সোমবার তাঁদের প্রচার মঞ্চ থেকে এই সম্ভাবনার কথাই শোনা গেল। এই ঘোষণা শুনে ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষের অনেকেরই প্রশ্ন, তা হলে আর অন্যদের সঙ্গে সংস্কারপন্থী কংগ্রেসের ফারাক রইল কোথায়?
সদ্য গত মাসের ২০ তারিখই বিদেশি পুঁজি বা এফডিআইয়ের বিরোধিতা করে বন্ধ ডেকেছিল বাম-বিজেপি। এ বার এফডিআইয়ের পক্ষ নিয়ে সওয়াল করতে গিয়েও একই হুমকি! অর্থাৎ, এ রাজ্যের কপালে এগোলেও কর্মনাশ, পিছোলেও তাই।
রাজ্য কংগ্রেসের এই কালিদাসি হুমকির দিনে অবশ্য দলের হাইকম্যান্ড সংস্কার নিয়ে প্রচার কর্মসূচির ঘোষণা করেছেন। দলের তরফে জানানো হয়েছে, দিল্লির রামলীলা ময়দান থেকে ২৮ অক্টোবর সনিয়া ও মনমোহন সিংহ এর সূচনা করবেন। লোকসভা নির্বাচন যখনই হোক, রামলীলার এই জনসভা থেকেই এক প্রকার নির্বাচনের দামামা বাজিয়ে দিতে চাইছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব।
মমতা যে ভাবে দিল্লি এসে ইউপিএ-সরকারকে সরাসরি আক্রমণ করেছেন, পাল্টা জোট গড়ার ডাক দিয়েছেন বা সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব আনার হুমকি দিয়েছেন, তাতে এই মুহূর্তে আতঙ্কিত হওয়ার কোনও কারণ দেখছে না কংগ্রেস। তারা মনে করছে, এখনই সরকারের পতনের কোনও সম্ভাবনা নেই। |
মমতার কাট-আউটের সামনেই সোমবার তৃণমূল-বিরোধী বক্তৃতা দীপা দাশমুন্সির। ছবি: রাজীব বসু। |
কারণ মুলায়ম সিংহ যাদব, মায়াবতীরা এখনই ইউপিএ-কে ত্যাগ করছেন না। অনেক দলই অকাল নির্বাচনের জন্য তৈরি নয়। কলকাতায় হাজরার মঞ্চ থেকে রাজ্য কংগ্রেস কিন্তু সরাসরি মমতা-বিরোধিতায় সরব হয়েছে। এফডিআই না-আনার সিদ্ধান্তে অনড় থাকলে রাজ্যের মানুষ তাঁকে ক্ষমা করবে না বলে মুখ্যমন্ত্রীকে আক্রমণ করেছেন প্রদেশ সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। মমতাকে সতর্ক করে তিনি এ দিন বলেন, “দিদিমণি আবার ভুল করছেন! সাবধান করে দিচ্ছি, এফডিআই-কে ফিরিয়ে দিলে রাজ্যের মানুষ আপনাকে ক্ষমা করবে না।” জমায়েত দেখে উজ্জীবিত প্রদীপবাবুর হুঁশিয়ারি, “কংগ্রেসের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। আর দরকার পড়লে বাংলা বন্ধের ডাক দেব!”
রাজ্যের উন্নয়ন নিয়ে এত কথা বলে শেষে বন্ধ? প্রদীপবাবুর যুক্তি, “বন্ধের পথে যেতে হোক, চাই না। রাজ্য সরকার যাতে এফডিআই আনতে বাধ্য হয়, তাই চাপ বাড়াতে চাইছি। না হলে শেষ অস্ত্র বন্ধ!”
বিড়লা তারামণ্ডলের কাছে ইন্দিরা গাঁধীর মূর্তির সামনে থেকে হাজরা পর্যন্ত মিছিল শেষে হাজরার সভায় কংগ্রেস নেতৃত্ব এ দিনও বোঝানোর চেষ্টা করেছেন, বিদেশি লগ্নি এলে বেকারত্ব কমে রাজ্য তথা দেশের আর্থিক বিকাশ হবে। রায়গঞ্জের সাংসদ দীপা দাশমুন্সির বক্তব্য, “এফডিআই রাজ্যে চালু করবেন কি না, তা আপনার (মমতা) ব্যাপার। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী ভেবে দেখুন, কেন এ রাজ্যে শিল্প আসছে না? কেন বিনিয়োগকারীরা আসছেন না? কেন সিঙ্গুরের ভবিষ্যৎ অন্ধকার?” দিল্লিতে মমতার এ দিনের আক্রমণে হতাশ হলেও কংগ্রেস হাইকম্যান্ড কিন্তু এখনও সংযত প্রতিক্রিয়াই জানাচ্ছে। কংগ্রেসের মুখপাত্র মণীশ তিওয়ারি বলেছেন, “আমরা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর রাজনৈতিক সংগ্রামকে শ্রদ্ধা করি। তবে সব রাজনীতিকেরই একটা সময় আসে, যখন বিরোধী থেকে প্রশাসক হয়ে উঠতে হয়, রাস্তার লড়াকু নেতা থেকে রাষ্ট্রনেতা হয়ে উঠতে হয়। এটা আত্মসমীক্ষা ও ব্যক্তিগত ইচ্ছার বিষয়।” সরাসরি আক্রমণে না-গিয়ে মমতার জন্য ভবিষ্যতের দরজাও খুলে রাখতে চাইছে কংগ্রেস। এমনকী, যন্তর মন্তরের মঞ্চে এনডিএ-র আহ্বায়ক শরদ যাদবের উপস্থিতিকেও বাড়তি গুরুত্ব দিতে নারাজ এআইসিসি। জঙ্গিপুরে লোকসভা উপনির্বাচনের প্রচারে গিয়ে এআইসিসি-র তরফে পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত নেতা শাকিল আহমেদও শরদ-প্রসঙ্গ নিয়ে কোনও কড়া মন্তব্য করতে চাননি।
প্রদেশ নেতারা অবশ্য এই প্রশ্নে মমতাকে রেহাই দিচ্ছেন না। প্রদেশ কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান মন্তব্য করেছেন, তৃণমূল নেত্রী ধীরে ধীরে এনডিএ-র সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছেন। মমতার দিল্লি-যাত্রাকে রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী মানস ভুঁইয়ার কটাক্ষ, “দিল্লিতে উনি লাড্ডু খেতে গিয়েছেন। কিন্তু লাড্ডু খেলেও বিপদ, না খেলেও বিপদ! তাঁকে পস্তাতেই হবে!” পাশাপাশি, দক্ষিণ কলকাতা জেলা কংগ্রেস সভানেত্রী মালা রায় সরব হয়েছেন হাজরায় সভা করা নিয়ে পুলিশি আপত্তির বিরুদ্ধে। তাঁর মন্তব্য, “মেট্রো চ্যানেলটা যে ভাবে তৃণমূল একা দখলে রাখছে, হাজরা মোড়টাও বোধহয় শুধু ওদেরই থাকবে! ”
প্রদেশ নেতারা রাজ্য রাজনীতিতে তাঁদের বাধ্যবাধকতা থেকে পথে নেমে পড়েছেন। জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতে সনিয়া-মনমোহন ময়দানে নামছেন দশেরার পরে। |