পুজোয় বহরমপুর শহর আলোয় সেজে উঠবে। বহরমপুর ব্যারাক স্কোয়ার ময়দানের চার কোণায় চারটি ছাড়াও কাজি নজরুল ইসলাম সরণি, গির্জা মোড়, ক্ষুদিরাম মূর্তির কাছে ও কুঞ্জঘাটা মোড়ে ৮ হাজার ওয়াটের ১টি করে এইচএমএল (হাই মাস্ট লাইট) লাগানো হবে। তার মধ্যে ব্যারাক স্কোয়ার ময়দানের চারটি আলো লাগানোর কাজ শেষ পর্যায়ে। বাকি চারটি আলো লাগানোর কাজ চলছে। ফরাক্কার এনটিপিসি’র সহায়তায় বহরমপুর পুর-কর্তৃপক্ষ দুর্গাপুজোয় আলো দিয়ে শহরকে মুড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মহালয়ার দিন ওই আটটি আলোর উদ্বোধন হবে। বহরমপুরের পুরপ্রধান নীলরতন আঢ্য বলেন, “বহরমপুরের ফুসফুস ব্যারাক স্কোয়ার ময়দান। ঐতিহাসিক ওই ময়দানের চারপাশের অস্থায়ী দোকান-ঘর ভেঙে পুরসভা সৌন্দর্য বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছে।”
সেই মতো ময়দানের চার দিক রাস্তা বরাবর পাঁচিল দিয়ে ঘিরে সেখানে সবুজায়ন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ব্যারাক স্কোয়ার ময়দানের রাস্তা বরাবর চারপাশ ৮০টি ত্রিফলা আলো দিয়ে সাজিয়েছে বহরমপুর পুরসভা। এতে সৌন্দর্য বাড়লেও ‘ঐতিহাসিক’ ময়দানের সর্বত্র ওই আলো পৌঁছাত না। ফলে বহরমপুর শহরের ‘ফুসফুস’ ওই ময়দানের চার কোণায় নতুন করে আরও চারটি এইচএমএল (হাই মাস্ট লাইট) লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয় পুর-কর্তৃপক্ষ। সেই মতো তাঁরা ফরাক্কার এনটিপিসি’র কাছে আবেদন জানান। ওই আবেদন মেনে এনটিপিসি কর্তৃপক্ষ ব্যারাক স্কোয়ারের পাশাপাশি পুরনো কান্দি বাসস্ট্যান্ড চত্বরে কাজি নজরুল ইসলাম সরণিতে, গির্জার মোড়, বহরমপুর রেল স্টেশন যাওয়ার পথে ক্ষুদিরাম মূর্তির কাছে এবং লালবাগ যাওয়ার রাস্তায় কুঞ্জঘাটা মোড়ে এইচএমএল বসানোর ব্যাপারে সায় দেয়। |
পুরপ্রধান বলেন, “এর আগে পুর-এলাকার বহরমপুর স্টেশন ও বাসস্ট্যান্ড চত্বরে দু’টি এইচএমএল লাগিয়ে দিয়েছে ফরাক্কার এনটিপিসি। এতে বহরমপুরবাসী দারুণ ভাবে উপকৃত হয়েছে। এর পরেই এনটিপিসি-র কাছে পুর-এলাকায় ৮টি এইচএমএল আলো বসানোর জন্য আবেদন করা হয়। ওই আবেদন মেনে নেয় এনটিপিসি।”
ফরাক্কা এনটিপিসি’র এইচআর দফতরের সহকারী ম্যানেজার অসীমকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বহরমপুরের পাশাপাশি জঙ্গিপুর পুরসভাতেও এইচএমএল বসানো হচ্ছে। বহরমপুরে ৮টি ও জঙ্গিপুরে ৪টি এইচএমএল বসানো হবে। কর্পোরেট সোশ্যাল রেস্পনসিবিলিটি কর্মসূচির আওতায় ওই আলো বসানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে বহরমপুরের সাংসদ অধীর চৌধুরী বিশেষ ভাবে অনুরোধ করেন। তাঁর অনুরোধে ওই আলো বসানো হচ্ছে।”
৬০ মিটার উচ্চতায় ওই এইচএমএল বসানো হবে। প্রতিটি এইচএমএল-এ ৮টি বাল্ব থাকে এবং প্রতিটি বাল্ব হাজার ওয়াটের। ফলে এইচএমএল-এ বিস্তীর্ণ এলাকা আলোকিত হয়। এনটিপিসি সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রতিটি এইচএমএল-এর মূল্য ২ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা। তবে ওই আলো জ্বালানোর জন্য এইচএমএলপিছু পুরসভার মাসে বিদ্যুৎ বিল হিসেবে বাড়তি ১২ হাজার টাকা গুণতে হবে।
পুরসভার ওই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান পুরবাসিন্দারা। বিশেষ করে আড়াইশো বছরের প্রাচীন ব্যারাক স্কোয়ার ময়দানের সৌন্দর্যায়ন বাড়ানোয় খুশি বহরমপুরের মানুষ। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের অধ্যক্ষ সোমেশ রায় বলেন, “এর আগে ব্যারাক স্কোয়ার ময়দানকে হেরিটেজ হিসেবে নোটিফিকেশন করে রাজ্য পুরাতত্ব পরিষদ। এত দিন অযত্নে ও অবহেলায় পড়ে ছিল ব্যারাক স্কোয়ার ময়দান। পুরবাসিন্দারা যেমন ওই মাঠে সান্ধ্যভ্রমণ করেন, তেমনি গরমের হাত থেকে রেহাই পেতেও মাঠে বসে অনেক রাত পর্যন্ত বসেও থাকেন অনেকে। সেক্ষেত্রে ময়দান ও ময়দান লাগোয়া এলাকা আলোকিত থাকলে তাঁরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করবেন না। এটা পুরসভার ভাল উদ্যোগ।”
ইতিহাস গবেষকদের কথায়, রাজধানী মুর্শিদাবাদের কাছে বহরমপুরে একটি শক্তিশালী সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ১৭৫৮ সালে লন্ডনে কোম্পানীর পরিচালকবর্গের কাছে প্রস্তাব পাঠায়। অনুমোদন পেয়ে সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলার জন্য জমির খোঁজ পড়ে। তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী মীরজাফরের দারস্থ হয়। মীরজাফর সামরিক ঘাঁটি গড়ার জন্য ৪০০ বিঘে জমি দান করেন। এর পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আরও ১৯৪ বিঘা জমি সংগ্রহ করে। এভাবে ১২৬.৯৫ একর জমির উপরে বহরমপুরে ১৭৬৫-১৭৬৭ সালে সেনা নিবাস গড়ে তোলার পাশাপাশি সেনা নিবাসকে কেন্দ্র প্রশাসনিক অঞ্চলও গড়ে ওঠে। ব্যারাক স্কোয়ার ময়দানের চারপাশে বাস্তুকার কর্ণেল এ ক্যাম্পবেল-এর তত্ত্বাবধানে ওই সেনা নিবাস নির্মিত হয়। তখন সেনা-ছাউনি, প্রশিক্ষণের বন্দোবস্ত ছাড়াও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরির উদ্দেশ্যেই ব্যারাক স্কোয়ার ময়দান তৈরি করা হয়।
ইতিহাস গবেষক খাজিম আহমেদ বলেন, “পলাশির যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পরে নবাব সিরাজের বশংবদ মিরজাফর মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে বসেন। কিন্তু প্রথম থেকেই ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আশঙ্কা ছিলই যে, মিরজাফর ফের বিদ্রোহ করতে পারেন। এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আশঙ্কা সত্যি হয়, যখন ওলন্দাজদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেন মিরজাফর।” খাজিম আহমেদ বলেন, “মিরকাশিম সম্পর্কেও ভয় ছিল ইংরেজদের। লর্ড ক্লাইভ এবং ওয়ারেন হেস্টিংস তাই মনে করেছিলেন, রাজধানী মুর্শিদাবাদের কাছাকাছি বহরমপুরে সেনা নিবাস গড়ে তোলা দরকার।” সেই মতো ১৭৬৭ সালে বহরমপুরে ব্যারাক স্কোয়ার ময়দান গড়ে ওঠে। |