নিজস্ব সংবাদদাতা • মেদিনীপুর |
আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে একটা সময়ে ছাত্র ও যুব ফ্রন্টের ‘যোগ্য’ কর্মীদের শ্রমিক সংগঠনে যুক্ত করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিম মেদিনীপুরে যে সেই উদ্যোগের ‘সুফল’ মেলেনি, এ বার তা মেনে নিল সিপিএমের শ্রমিক সংগঠন সিটু। রবিবার রাতে শেষ হয়েছে সংগঠনের সপ্তম পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্মেলন। সম্মেলনের সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে রাখঢাক না-করেই লেখা হয়েছে, ‘জেলায় শিল্প কারখানা বৃদ্ধির পাশাপাশি অসংগঠিত ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য যে পরিমাণ দক্ষ যোগ্য কর্মী প্রয়োজন, সে দিকে লক্ষ্য রেখে ছাত্র ও যুব ফ্রন্টের কর্মীদের যুক্ত করা হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে। তবে বলা যায় প্রথম প্রচেষ্টা তেমন সাফল্যের মুখ দেখেনি।’
কেন প্রথম প্রচেষ্টা সাফল্যের মুখ দেখল না, তা নিয়েও চর্চা হয়েছে সংগঠনের অন্দরে। একাংশ নেতৃত্বের বক্তব্য, সিপিএমের ‘ক্ষমতাসীন’ গোষ্ঠীর ‘ঘনিষ্ঠ’দের নেতা করা হয়েছে, আর ‘বিক্ষুব্ধ’ গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠদের উপেক্ষা করা হয়েছে। এই পক্ষপাতিত্বের কারণেই যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলা যায়নি। ‘প্রথম প্রচেষ্টা তেমন সাফল্যের মুখ দেখেনি’ সম্পাদকীয় প্রতিবেদনে এই স্বীকারোক্তিতে নেতৃত্ব বাছাই সঙ্কটের কথাই তুলে ধরা হয়েছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
রবিবার খড়্গপুরের রবীন্দ্র ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হয়েছে সিপিএমের শ্রমিক সংগঠনের জেলা সম্মেলন। সম্মেলনের শুরুতে সম্পাদকীয় প্রতিবেদন পেশ করেন সংগঠনের জেলা সম্পাদক বিশ্বনাথ দাস। পরে তা নিয়ে আলোচনা হয়। শ্রমজীবী মানুষকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সর্বস্তরের নেতৃত্বেরই যে ‘দুর্বলতা’ ছিল, তা স্বীকার করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বিশাল সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষকে সংগঠিত করতে, পেশাভিত্তিক সংগ্রাম আন্দোলন গড়ে তুলতে যে বিশাল সংখ্যক কর্মী বা নেতৃত্ব দরকার তা জেলায় গড়ে তোলা যায়নি। আবার কর্মীদের মতাদর্শে শিক্ষিত করে তোলার ক্ষেত্রেও তেমন ভাবে উদ্যোগী হওয়া হয়নি। সর্বস্তরেই নেতৃত্বের দুর্বলতা ও অন্যমনস্কতা অস্বীকার করা যায় না।’ বিরোধীদের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের নানা প্রসঙ্গ উঠে এলেও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘কিন্তু যে কথা আমাদের স্বীকার করতেই হবে তা হল আমাদের প্রদেশে সংগঠিত শ্রমিক আন্দোলন সক্রিয় ও সচেতন ভাবে এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে সে ভাবে রুখে দাঁড়াতে পারেনি। এদের চরিত্র সম্পর্কে অতীত অভিজ্ঞতা ও ধারণা থাকলেও এদের ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়াশীল কার্যকলাপের মোকাবিলায় জনগণকে সঙ্গে নিয়ে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলায় শ্রমিক শ্রেণি ও তার অগ্রগামী বাহিনী সক্ষম হয়নি। যে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে শ্রমিক শ্রেণির শত্রুরা শিল্প বিরোধিতায় নেমেছিল, তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য ব্যাপক শ্রমজীবী মানুষ ও তাদের সহযোগীদের যে দৃঢ় সাংগঠনিক সক্রিয়তা, মতাদর্শগত উপলব্ধি ও রাজনৈতিক সচেতনতা থাকা উচিত ছিল, তা তৈরি করা যায়নি।’
তবে এ জেলায় জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে সংগঠনের ‘সতর্কতার’ অভাব ছিল না বলেই দাবি সিটু নেতৃত্বের। তাঁদের বক্তব্য, এই জন্যই এখানে অশান্তি হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পশ্চিম মেদিনীপুরে এই পরিস্থিতিতে কিছুটা আগাম প্রস্তুতি ও সতর্কতার সঙ্গে শিল্প স্থাপনের কাজে সক্রিয়তা অর্জন করতে পারায় শালবনির ইস্পাত কারখানার জন্য জমি এবং খড়্গপুরে শিল্পতালুকের জন্য কৃষকদের কাছ থেকে জমি সংগ্রহে সাফল্য এসেছিল। জমির মালিক ও কৃষক-সহ এলাকাবাসীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছিল বারবার। জমির মূল্য, জমিদাতা পরিবারের এক জনের চাকরি ও কিছু মানুষের নতুন জায়গায় পুনর্বাসন-সহ শিল্পের প্রসারে অর্থনৈতিক সুযোগবিশেষত এলাকার মানুষের এ সবই আলোচনায় এসেছিল। ফলে কৃষক-সহ জমিদাতারা স্বেচ্ছায় সচেতন ভাবে জমি দিয়েছিলেন। কৃষকেরা প্ররোচনাকে অস্বীকার করেছিলেন। খড়্গপুরে শিল্প তালুকের টাটা টেলকন কারখানা সিঙ্গুরের ন্যানো কারখানার চেয়ে কম নয়।’
এই পরিস্থিতিতে ‘চিহ্নিত’ ভুল-ত্রুটিগুলি শুধরে সেই আন্দোলনে নামারই ডাক দিয়েছে সিটু। প্রতিবেদনে স্পষ্টই বলা হয়েছে, ‘বিধানসভা নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে হঠাৎ উদ্ভুত নজিরবিহীন প্রতিকূলতায় থমকে যাওয়া অবস্থার কিছু পরিবর্তন হচ্ছে। তবে আড়ষ্ঠতা একাংশের মধ্যে ভয়ভীতি এখনও থেকে যাচ্ছে। খেয়াল রাখতে হবে যে প্রতিকূলতার মধ্যেও সম্ভাবনার নিত্যনতুন উপাদান তৈরি হচ্ছে। আন্দোলন চলবেই।’ ‘সম্ভাবনার নিত্যনতুন উপাদান’কে কাজে লাগিয়ে আগামী দিনে সিটু এ জেলায় ‘ঘুরে দাঁড়াতে’ পারে কি না, সেটাই এখন দেখার।
|