এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে তৃণমূলের আশ্বাস ছিল, ‘দলতন্ত্রমুক্ত’ স্বচ্ছ প্রশাসনের। কিন্তু এখন তৃণমূলের অন্দরেই অভিযোগ, দলের লোকজনও ‘দলতন্ত্রের’ শিকার!
হুগলি জেলায় দলের অন্দরে এমন নানা কোন্দল বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্যে আসছে। গত শনিবার উত্তরপাড়া বিধানসভার অন্তর্গত কানাইপুরে সরকারি অনুষ্ঠানে স্থানীয় তৃণমূল পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির নাম কার্ডে ছাপানো হয়নি। পর দিন শ্রীরামপুরেও একই ঘটনার ‘শিকার’ দলের স্থানীয় কাউন্সিলর।
কানাইপুর পঞ্চায়েত এলাকায় কেএমডিএ-র জল প্রকল্পের শিলান্যাস অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ ববি হাকিম, সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিধায়ক অনুপ ঘোষাল প্রমুখ। অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্রে অতিথিদের তালিকায় সিপিএমের পঞ্চায়েত প্রধানের নাম ছাপানো হয়নি। স্থানীয় শ্রীরামপুর-উত্তরপাড়া পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল সভাপতি রেবা কুশারির নামও তাতে ছিল না। অথচ নাম ছিল জাঙ্গিপাড়ার দলীয় বিধায়কের (প্রকল্প এলাকা থেকে বহু দূরে পৃথক সাংসদ এলাকা)। এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ‘অসৌজন্যের রাজনীতি’র অভিযোগ যেমন উঠেছে, তেমনি পঞ্চায়েত ভোটের প্রাক্কালে পঞ্চায়েত সমিতির আমন্ত্রণপত্রে ব্রাত্য থাকায় ‘গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে’র বিষয়টিও মাথাচাড়া দিয়েছে। বিষয়টি মেনে নিচ্ছেন তৃণমূলের অনেক নেতাই। তবে, রেবাদেবী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। পঞ্চায়েত প্রধান অবশ্য হাজির হননি। এ বিষয়ে সিপিএমের হুগলি জেলা সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরী বলেন, “আমন্ত্রণপত্রে বিরোধীদের নাম না দেওয়াই ওদের রীতি। ওরা এতেই অভ্যস্ত।”
ঘটছে আরও কিছু ‘অপ্রীতিকর’ ঘটনা। গত রবিবার পশ্চিম শ্রীরামপুরে (৪ নম্বর ওয়ার্ড) জিটি রোডের ধারে একটি রাস্তার উদ্বোধন করেন স্থানীয় সাংসদ কল্যাণবাবু। তাঁর সাংসদ তহবিলের টাকায় রাস্তাটি তৈরি করে শ্রীরামপুর পুরসভা। আমন্ত্রণপত্রে দেখা যাচ্ছে, নিমন্ত্রণ করা হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীদের নামে।
সরকারি টাকায় তৈরি রাস্তার উদ্বোধনের চিঠি একটি রাজনৈতিক দল কেন পাঠাবে, তা নিয়েই গুঞ্জন চলছে বিভিন্ন মহলে। কংগ্রেসের জেলা সভাপতি দিলীপ নাথ বলছেন, “এটা সম্পূর্ণ নিয়ম বহির্ভূত। কেন্দ্রীয় সরকারের টাকায় রাস্তা তৈরি হল। টাকা মঞ্জুর করলেন জেলাশাসক। অথচ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দলতন্ত্র কায়েম করছে তৃণমূল।” সুদর্শনবাবুর সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, “যা চলছে, দেখছি। সবাই দেখছেন। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন।” অতিরিক্ত জেলাশাসক (উন্নয়ন) আবিদ হোসেন অবশ্য বলেন, “পুর এলাকার রাস্তা হওয়ায় পুরসভা কর্তৃপক্ষের তরফেই কার্ড ছাপানোটাই নিয়ম।”
শুধু বিধি ভাঙাই নয়, ওই অনুষ্ঠানকে ঘিরে শ্রীরামপুরে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ফের প্রকাশ্যে এসে পড়ছে। তৃণমূল সূত্রেই খবর, সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর রেখা ঘোষরায় অনুষ্ঠানে ডাক পাননি। অভিযোগ, এর নেপথ্যে রয়েছে প্রাক্তন এক কাউন্সিলরের সঙ্গে রেখাদেবীর গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। দলের একাধিক জেলা নেতা বলেন, “যা চলছে, তাতে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। দলের নামে চিঠি দেওয়াটাও ঠিক হয়নি।” এ দিনের অনুষ্ঠানে কার্ডে নাম থাকা সত্ত্বেও গরহাজির ছিলেন শ্রীরামপুরের তৃণমূল বিধায়ক, পুরপ্রধান এবং উপ-পুরপ্রধান। রাস্তাটি চাঁপদানি পুরসভার অন্তর্গত। সেখানকার বিধায়কের নামও কার্ডে ছাপা হয়নি।
রেখাদেবী বলেন, “শুধু আমি নই, অনুষ্ঠানের কথা পুরসভার অনেকেরই অজানা ছিল। অথচ, আমার চিঠিতেই রাস্তাটা হয়েছে।” পুরপ্রধান অমিয় মুখোপাধ্যায় বলেন, “অনুষ্ঠানের আগের রাতে কেউ এসে চিঠি দিয়ে যায়। কে দিয়েছে জানি না। চিঠি নিয়ে অনেক প্রশ্নও রয়েছে। বিতর্ক এড়াতেই যাইনি।” গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের বিষয়টি অবশ্য সরাসরি মানতে চাননি কেউ-ই। তৃণমূলের জেলা সভাপতি তপন দাশগুপ্ত বলেন, “বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখব।”
রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই হুগলির বিভিন্ন জায়গায় দলীয় নেতাদের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে তৃণমূল জেরবার। এ ব্যাপারে দলীয় নেতৃত্ব বারবার হুঁশিয়ারি দিলেও দলের অন্দরের কোন্দল থামার কোনও লক্ষণ নেই। সম্প্রতি রিষড়ায় স্থানীয় সাংসদ এবং বিধায়ক গোষ্ঠীর নেতা-কর্মীদের মধ্যে রাস্তার মধ্যেই মারামারি হয়। মারামারির জেরে কার্যত রাস্তা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। কিছু দিন আগে ধনেখালিতে স্থানীয় বিধায়ক এবং জেলা সভাপতির গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ হয়। তারকেশ্বরের পিয়াসারাতে যুব তৃণমূলের এক নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে দলেরই সমর্থকদের উপরে হামলা চালানোর। ব্যবসায়ী প্রহৃত হন। ‘উপদ্রবে’ তিতিবিরক্ত ব্যবসায়ীরা ব্যবসা বন্ধ করেন। কয়েক মাস আগে একই পরিস্থিতি হয় জাঙ্গিপাড়াতেও।
এই সমস্ত গোলমালের বিষয় দলের রাজ্য নেতৃত্বের কানেও পৌঁছচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সম্প্রতি চুঁচুড়ায় দলীয় সম্মেলনে এসে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় দলের নেতাদের কড়া হুঁশিয়ারি দেন। যদিও দলেরই একাংশের অভিমত, রাজ্য নেতৃত্বের হুঁশিয়ারি যে দলের নিচুতলায় কোনও প্রভাব ফেলেনি, একের পর এক ঘটনাতে তা স্পষ্ট। দলের এক শ্রেণির নেতাদের বিরুদ্ধে দুষ্কৃতীদের সঙ্গে ‘মাখামাখি’ নিয়েও দলে শোরগোল পড়ে। শ্রীরামপুরে খুনের আসামী এক দুষ্কৃতীকে ছাড়াতে এক তৃণমূল নেতা রাতভর থানায় ‘ধর্না’ দেন। বিষয়টি এমন পর্যায়ে পৌঁছয়, বৈঠক ডেকে নেতা-কর্মীদের হুঁশিয়ারি দিতে হয় তৃণমূল নেতৃত্বকে। কিন্তু তারপরেও পরিস্থিতি যে অপরিবর্তিত, একের পর এক ঘটনা সে দিকেই ইঙ্গিত করছে। |