আমার এক তার্কিক বন্ধু আছে। তার সামনে কোনও আলগা কথা বলার জো নেই, অমনি কেন বললে? এটা কি বলা যায়? সে দিন যে এর উল্টোটা বলেছিলে? এক জনের বেলায় এটা সত্যি হলে আর এক জনের বেলায় নয় কেন? ইত্যাদি ইত্যাদি। সোক্রাতেসকে চোখে দেখিনি। কিন্তু তিনি কী ভাবে এথেন্সবাসীর প্রাণ ওষ্ঠাগত করে তুলতেন, সেটা বিলক্ষণ বুঝতে পারি। তো, আমার এই বন্ধুটি আবার কাউকে নিয়ে ঠাট্টাতামাশা মোটে পছন্দ করে না, কারও মুদ্রাদোষ নিয়ে হয়তো একটা নির্দোষ রঙ্গ করা হল, কিংবা কারও হাঁটাচলা, কথা বলা নকল করল কেউ, অমনি তার মুখ গম্ভীর। কত বুঝিয়েছি, ‘যাকে নিয়ে রসিকতা করা হল সে তো আর জানতে পারছে না! জানলে তার মনে আঘাত লাগত, তাই কাজটা অন্যায় হত, না জানলে তো আর সে সমস্যা নেই, তা হলে একটু মজা করতে দোষ কী?’ অমোঘ প্রতিপ্রশ্ন, ‘যেটা জানলে এক জন কষ্ট পেতে পারে, সেটা করে মজা পাবে কেন? আর যদি পাও-ও, মজা পেতে হবেই বা কেন? তেমন মজা পাওয়ার দরকার কী?’ অগত্যা ‘রামগরুড়ের বড়পিসিমা’ বলে মুখ বেঁকিয়ে রণে ভঙ্গ দিতে হয়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টেলিভিশন চ্যানেলে মনমোহন সিংহের বাচনভঙ্গি নকল করেছেন। চতুর্দিকে তাঁর এই আচরণের খুব নিন্দেমন্দ হয়েছে। নিন্দে স্বাভাবিক, জরুরিও। একটা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী টিভি চ্যানেলে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে ভেঙিয়ে কথা বলছেন, এটা সভ্যতা নয়। ‘মনুদা’র ওপর ভয়ানক রাগ হয়েছে বলেই যে এমন আচরণ করা যায় না, মাথা ঠান্ডা হলে মুখ্যমন্ত্রী নিজেও মনে হয় সে কথা স্বীকার করবেন। তাঁর উচিত ছিল, এই অন্যায় আচরণের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া, কেবল প্রধানমন্ত্রীর কাছে নয়, সকলের কাছে। অ-শোভন এবং অ-সভ্য আচরণের জন্য ক্ষমা চাইতে লজ্জার কিছু নেই, বরং তাতে নিজের সম্মান বাড়ে। মুখ্যমন্ত্রী একটু ভাবলেই বুঝবেন, সে দিন প্রধানমন্ত্রীর কোনও অসম্মান হয়নি, অসম্মান হয়েছে তাঁর নিজেরই। সত্যি বলতে কী, আমরা কেউই অন্য কারও অপমান করতে পারি না, যখন কাউকে অপমান করছি ভাবি তখন আসলে নিজেরই অপমান করি। এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেহেতু মুখ্যমন্ত্রী, তাই তাঁর জন্য গোটা পশ্চিমবঙ্গের মাথা হেঁট হয়েছে। আশা করব, মুখ্যমন্ত্রী অন্যায় স্বীকার করে নিজের সম্মান কিছুটা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করবেন। মা মাটি মানুষেরও।
কিন্তু নানা মিডিয়ায় মুখ্যমন্ত্রীর আচরণের রকমারি প্রতিক্রিয়া দেখে, শুনে এবং পড়ে অন্য দু’একটা কথাও মনে হয়েছে। এক, মনমোহন সিংহ বয়স্ক, সজ্জন, ভদ্র মানুষ, তদুপরি পিএইচ ডি, তাই তাঁকে ভেঙানো খুব বড় অপরাধ এই যুক্তির কোনও মানে নেই। আমরা প্রাতিষ্ঠানিক সম্মান দেওয়া না দেওয়ার ব্যাপারটাকে ব্যক্তিগত গুণাবলির সঙ্গে বড় বেশি জড়িয়ে ফেলি, নেতা এম এ পাশ হলে পাঁচ সিকে বাড়তি সম্মান পান। মনমোহন সিংহ শিক্ষিত, সজ্জন, সেই কারণে ব্যক্তিগত পরিসরে তিনি নিশ্চয়ই বাড়তি সম্মান দাবি করতে পারেন, কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তাঁর যে মর্যাদা, সেটা তাঁর অর্জিত ডিগ্রি বা ক্যারেকটার সার্টিফিকেটের ওপর নির্ভর করে না। বস্তুত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যক্তিগত ভাবে নিজের অমর্যাদা করেছেন কি না, সেটাও এখানে গৌণ প্রশ্ন। তিনি তাঁর আসনের অমর্যাদা করেছেন, তার সঙ্গে তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা বা চারিত্রিক ভাবমূর্তির কোনও সম্পর্ক নেই।
দুই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী সম্বন্ধে যা বলেছেন, যে ভাবে বলেছেন, তাতে অবজ্ঞা আছে, রাগ আছে, অসৌজন্য আছে, সভ্যতার অভাব আছে, মন্ত্রিসভার অভ্যন্তরীণ আলোচনার খুঁটিনাটি প্রকাশ্যে জানিয়ে দেওয়ার অসংযম আছে, কিন্তু এই আচরণকে ভয়ানক ঘৃণা, বিদ্বেষ বা কুৎসিত গালিগালাজের সঙ্গে একাসনে বসিয়ে দিলে অন্যায় হবে। শ্রীযুক্ত অনিল বসু জনসভার ভাষণে বিকট অঙ্গভঙ্গি সহযোগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পর্কে যে উপমা প্রয়োগ করেছিলেন, সেই কদর্যতার তো কোনও তুলনাই হয় না, কিন্তু নেতাজিকে ‘তোজোর কুকুর’ বলা বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি ‘যমের অরুচি’ অভিধা ছুড়ে দেওয়ার মধ্যেও তীব্র বিদ্বেষ নিতান্ত প্রকট ছিল। বস্তুত, মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক প্রমুখ বিবিধ অনুগামীর কথাবার্তাতেও বিভিন্ন উপলক্ষে বিদ্বেষের পরিচয় মিলেছে। সি এন এন-আই বি এন-এর ঘটনাটা ভিন্ন গোত্রের। আপত্তিকর নিশ্চয়ই, কিন্তু সব আপত্তিকর আচরণকে এক সারিতে বসালে আপত্তির ওজন কমে যায়। আর একটা গুরুতর কথাও চাপা পড়ে যায়। শিষ্টতার অভাব মানেই বিদ্বেষ নয়। মুখ্যমন্ত্রীর বাগ্ভঙ্গি পরিশীলিত নয়, সে কথা সত্য, এবং তাতে কোনও গৌরব আছে বলেও মনে করি না। কিন্তু অত্যন্ত পরিশীলিত ভাবে উৎকৃষ্ট ভাষায় ভয়ঙ্কর বিদ্বেষের বিষ-তির ছুড়ে দেওয়া যায়, তার বিস্তর নমুনা টেলিভিশনের সান্ধ্য বৈঠকখানায় প্রায়ই দেখি। নেতাদের কথার ভঙ্গি শোভন হওয়া বাঞ্ছনীয়, কিন্তু কথার পিছনে থাকে মনের ভাব, সেটা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্যের রাজনীতিতে ও সমাজে বিদ্বেষের হাওয়া ক্রমশই বাড়ছে, তাই এই কথাটা বিশেষ করে খেয়াল রাখা ভাল।
প্রশ্ন উঠবে, কী করে জানা গেল মুখ্যমন্ত্রীর কথার পিছনে বিদ্বেষ ছিল না? সঙ্গত প্রশ্ন। এবং এখান থেকেই তিন নম্বর তর্কটা ওঠে। ব্যঙ্গবিদ্রুপ আর বিদ্বেষের মধ্যবর্তী সীমারেখাটি অনেক সময়েই বেশ অস্পষ্ট। কোন বিদ্রুপ নির্দোষ আর কোনটি গর্হিত, কে ঠিক করবে? অম্বিকেশ মহাপাত্রের সিদ্ধান্তই এ ক্ষেত্রে শেষ সত্য নয় নিশ্চয়ই। আমার কাছে যা নির্দোষ রসিকতা, আপনার বিচারে তা আপত্তিকর হতেই পারে। রসবোধের সংজ্ঞা এবং গ্রাহ্যতা কেবল কালক্রমেই পালটায় না, একই সময়ে বিভিন্ন সমাজে, বিভিন্ন পরিস্থিতিতেও সেটা আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। এমনকী ব্যক্তিবিশেষেও রসিকতার ধারণা পালটে যায়, কত বার কত মজার কথা বলে ফ্লপ হয়ে ‘অরসিকেষু রসস্য নিবেদনম্...’ বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিয়েছি, কিন্তু ভালই জানি, যাকে অরসিক বলছি সে আসলে ভিন্ন রসের রসিকমাত্র।
তা হলে উপায়? আবার বলব, একশো বার বলব, মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসলে নিজেকে সংযত রাখতে হয়, প্রধানমন্ত্রী কেন, কাউকেই ‘মিমিক’ করা যায় না, হাজার ইচ্ছে হলেও। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসে যা করা যায় না, সেটা অন্য আসনে বসেই বা করা যাবে কেন? ও রকম করা যদি ঠিক না হয়, তা হলে আমি-আপনিই বা একে ওকে তাকে নকল করে মজা পাই কী করে? সেটা বুঝি দোষের নয়? তার পরে ধরুন, বড় বড় নেতা, অভিনেতা ইত্যাদিকে নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র, রঙ্গরসিকতা, সে সবও কি তবে অন্যায় নয়? তাঁদের মনে যদি আঘাত লাগে?
দাঁড়ান, দাঁড়ান, এই সব কূটপ্রশ্নের ভয়েই তো সেই বন্ধুটির সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর এই সাম্প্রতিকতম কীর্তিটি নিয়ে মোটে কথা তুলিনি। সব সময় অত ‘প্রপার’ হয়ে চলতে গেলে বেঁচে থেকে লাভ কী? আমাদের প্রধানমন্ত্রীর রোবটপ্রতিম বাচনভঙ্গি দেখে যদি একটু আধটু নকল করে ফেলতে ইচ্ছে করে, তা হলে এক বার এ দিক ও দিক তাকিয়ে নিয়ে, সত্যি বলছি... |