প্রবন্ধ ১...
শুধু ভয় দেখালেই হবে? সমাধান খুঁজবেন না?
সেচ পাম্পে বিদ্যুৎ সংযোগের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আমার যে বক্তব্য এই কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল (‘খাদ্যের চাহিদা মেটাতে সেচ-পাম্পে বিদ্যুৎ চাই’, অগস্ট ৩০) তার বিপক্ষে কল্যাণ রুদ্রের প্রবন্ধ (‘যত খুশি জল তুলব? ওঁরা ঠিক বলছেন না’ ৫ সেপ্টেম্বর) পড়লাম। ভূগর্ভের জলের ব্যবহার বিধি, আর্সেনিক দূষণ, চাষির চাহিদা এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা, এই বিষয়গুলির পরিপ্রেক্ষিতে সেচ নীতি নির্ধারণে এই বিতর্কটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই কল্যাণবাবুকে ধন্যবাদ জানিয়ে, তাঁর কয়েকটি আপত্তি নিয়ে আলোচনা করছি।
কল্যাণবাবু বলছেন, পশ্চিমবঙ্গের ভূগর্ভের জল দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, অতএব কৃষকরা জল তুললে মহাবিপদ। আমাদের রাজ্যে গড়পড়তা জমির পরিমাণ অত্যন্ত কম। কৃষককে জীবিকা নির্বাহ করতে তাই দু-তিনটে চাষ করতেই হয়। ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যে খাল, নালা, পুকুরের জল শুকিয়ে যায়। অতএব ভূগর্ভের জল না তুললে তাঁরা গ্রীষ্মে চাষ করবেন কী করে? ভূগর্ভের জল ছাড়া সেচের অন্য কোনও বিকল্প যদি চাষির কাছে না থাকে, কল্যাণবাবু কি তা হলে চাষিকে চাষ বন্ধ করে দিতে বলবেন? আমি বলছি, সঠিক নীতি তৈরি করতে পারলে, কৃষক চাষও করতে পারবে, পরিবেশও নষ্ট হবে না।
এই জল নষ্ট করা কৃষকের সামর্থ্যের অতীত।
উনি লিখেছেন, বিষয়টা যখন সেচের জল, তখন গবেষণা শুরু হোক কৃষকদের দিয়ে। তাই শুরু করলাম। সম্প্রতি কথা হয়েছে বীরভূমের নানুর ব্লকের কৃষিজীবী বসির, বাঁকুড়ার কোতলপুর ব্লকের বিবেকানন্দ আর নদিয়ার চাকদহ ব্লকের বাবুর সঙ্গে। এঁরা বললেন, এ বছর বৃষ্টিপাত এতটই কম হয়েছে যে, বিদ্যুৎ-চালিত নলকূপ না থাকলে আমন ধানের সর্বনাশ হয়ে যেত। আমি কিন্তু শুধু এই তিন জনের কথার উপর ভিত্তি করে এই লেখাটা লিখছি না। গত ২০০৪ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ১৫টি জেলায় প্রায় ৯০০টি কৃষক পরিবারের থেকে আমরা অনবরত অর্থনৈতিক তথ্য সংগ্রহ করে চলেছি। চাষের জন্য ভূগর্ভের জলের ওপর তাঁদের নির্ভরতা, ও সেই জলের অভাবে নিশ্চিত দারিদ্র ও অনাহারের তিক্ত সত্য ফুটে আসছে এই তথ্য থেকে। বেশ কয়েকটি দেশি ও বিদেশি জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধে এই তথ্যগুলি তুলে ধরেছি।

শ্রীরুদ্রর লেখার শিরোনাম ‘যত খুশি জল তুলব?’ অর্থাৎ, আমাদের কৃষকরা যত খুশি জল তুলে সর্বনাশ ডেকে আনছেন। এটা কি ঠিক? যে কৃষকরা ৪৫ টাকা লিটার দরে ডিজেল কেনেন (এখন ৫০ টাকা!) এবং ইউনিট প্রতি ৫.৮৮ টাকা পর্যন্ত বিদ্যুতের বিল দেন, তাঁরা কেন অর্থের অপচয় করে প্রয়োজনের অতিরিক্ত জল তুলবেন? আমাদের তথ্য দেখাচ্ছে যে, বিদ্যুতের মিটার লাগার পরে কৃষকেরা বর্ষায় অত্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া জল তুলছেন না। বোরো মরসুমেও জল আগের তুলনায় কম তুলছেন, যদিও তাতে বোরোর ফলন কমেনি। অর্থাৎ, কৃষকেরা জলের অপচয় করছেন, এই অপবাদ দেওয়া চলে না।
এ বার জলস্তর নিয়ে কথা বলা যাক। কল্যাণবাবুর সঙ্গে আমার অনেক মতভেদ আছে, কিন্তু এক জায়গায় আমরা একমত। পশ্চিমবঙ্গ জল অনুসন্ধান দফতরের তথ্য অসম্পূর্ণ, তাতে প্রচুর অসামঞ্জস্যও রয়েছে। প্রায় দু’ হাজার নলকূপের তথ্য ঘেঁটে দেখেছি যে, মাত্র ৫০৮টি নলকূপে বর্ষার আগে (এপ্রিল বা মে) এবং বর্ষার পরের (নভেম্বর বা ডিসেম্বর) তথ্য আছে ১৯৯০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত। কল্যাণবাবু জল অনুসন্ধান দফতরের তথ্য ভাণ্ডার থেকে বলছেন, ২৯৬টি ব্লকে জলস্তর নেমে যাচ্ছে। এখানে বলে রাখি যে, বর্ষার আগের জলস্তর কখনও মাপা হয় এপ্রিল মাসে, কখনও বা মে মাসে। অনিবার্য ভাবেই মে মাসে জলস্তর এপ্রিল মাসের চেয়ে নীচে থাকে, অতএব ২০০৬ পর্যন্ত এপ্রিল মাসের জলস্তরের সঙ্গে মে মাসে জলস্তর নীচে থাকে, তাই এপ্রিল মাসের জলস্তরের সঙ্গে মে মাসের জলস্তর তুলনা করা একেবার বৈজ্ঞানিক নয়। কিন্তু তথ্যের অভাবে তা-ই করতে হচ্ছে। বাকি নলকূপের তথ্য অসম্পূর্ণ, যার ভিত্তিতে কোনও সিদ্ধান্তে আসা যায় না।
৫০৮টি নলকূপের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে, বর্ষা আগে ২৫ শতাংশ নলকূপের জলস্তর নেমে গেছে। কিন্তু ৭০ শতাংশ নলকূপে জলস্তর কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হচ্ছে না। কিন্তু যে ২৫ শতাংশ নলকূপে জলস্তর নেমে গিয়েছিল, তার মধ্যে প্রায় ১২ শতাংশ নলকূপে বর্ষার পরে জলস্তর আবার আগের জায়গায় উঠে এসেছে। মানে, মাত্র ১৩ শতাংশ নলকূপে বর্ষার আগে এবং পরে জলস্তর নেমেছে গত কুড়ি বছরে। এই ব্লকগুলিকেই সরকার আধা সংকটজনক বলে ঘোষণা করেছে এবং এখানে বিধিনিষেধ থাকছে। বাকি ৮০-৮৫ শতাংশ নলকূপে জলস্তর যেখানে অপরিবর্তিত আছে, সেখানে বিধিনিষেধ থাকা উচিত কি না, সেটা নিয়েই আমাদের বিতর্ক।
কল্যাণবাবুর তথ্যের সঙ্গে আমার তথ্য মিলছে না কেন? কারণ, প্রথমত, উনি অসম্পূর্ণ তথ্য ব্যবহার করেছেন, যেখানে আমি গত কুড়ি বছরের সম্পূর্ণ তথ্য পাওয়া যায় এমন ৫০৮টি নলকূপ হিসেবে নিয়েছি। দ্বিতীয়ত, উনি জলস্তরের দীর্ঘকালীন প্রবণতাগুলির পরিসংখ্যানগত তাৎপর্য (যাকে বলা হয় Statistical Significance) না দেখেই সেগুলোকে জলস্তর ‘নামা’ বা ‘ওঠা’ হিসেবে নির্দিষ্ট করেছেন। তৃতীয়ত, উনি জানুয়ারি মাসের জলস্তর দেখছেন, যখন সরকারি পদ্ধতি অনুযায়ী নভেম্বর মাসের জলস্তর দেখার কথা। জানুয়ারি মাসে সেচ শুরু হয়ে যায়, তাই ওই মাসের তথ্য থেকে বর্ষার পর জল কতটা বাড়ল, সেটা বোঝা যায় না। কল্যাণবাবুর তথ্য যদি ঠিক হয়, তা হলে সরকার মাত্র ৩৮টি ব্লককে আধা-সংকটজনক ঘোষণা করল কেন? যদি আরও অনেক ব্লকে দু’টি মরসুমেই জলস্তর নামছে, তা হলে সেগুলি সবই তো আধা-সংকটজনক বা সংকটজনক হওয়া উচিত ছিল সরকারি নিয়মেই।
মূল কথা হল, যে সব ব্লকে জলস্তর নেমে গিয়েছে, সেখানেও কিন্তু গড় জলস্তর বেশ ভাল এবং বর্ষার পরে সেই সব জায়গায় জলস্তর উঠে আসছে। কারণ, পশ্চিমবঙ্গে প্রচুর বৃষ্টি হয় এবং পলিমাটি থাকার ফলে মাটির নীচের জলভাণ্ডার ভরে ওঠার প্রক্রিয়াটা (Recharge) ভাল হয়। অবশ্যই জল ভরে-ওঠার হার আরও বাড়ানো দরকার। বর্তমানে জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিরাপত্তা প্রকল্পে এ রাজ্যের খাল-বিল-পুকুর-নালা সংস্কারের যে কাজ শুরু হয়েছে, রাজ্য সরকার সে কাজ অগ্রাধিকার দিলে বর্ষার জল আরও দ্রুত ভূগর্ভস্থ জলসম্পদকে পরিপূর্ণ করে তুলবে। জল ব্যবহার করার সঙ্গে সঙ্গে, জল ধরতে আর জল ভরতে হবে, এটা আমরা সব সময় বলছি।
কল্যাণবাবু বলছেন, সাবমার্সিবল পাম্প চালু হওয়ায় আরও নিচু স্তর থেকে আরও বেশি জল তুলছেন কৃষকরা। কিন্তু বিদ্যুৎ ছাড়া তো সাবমার্সিবল পাম্প চলে না, পশ্চিমবঙ্গে যে পাঁচ লক্ষাধিক পাম্প আছে, তার মাত্র ১৭ শতাংশেরও কম বিদ্যুতে চলে। বেশি জল কী দিয়ে তুলবেন কৃষকরা? ২০০৮ সাল পর্যন্ত মজুর এবং সার-বাবদ খরচের সূচক ১০০ পয়েন্ট থেকে বেড়ে ১৩৬ ও ১১৫ হয়েছে, সেখানে সেচ-বাবদ খরচের সূচক বেড়ে হয়েছে ২২৩ পয়েন্ট। ডিজেল থেকে পরিবেশ দূষণের কথা না-হয় ছেড়েই দিলাম।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে দেখা যাচ্ছে যে, মোট ৩৮ হাজার গ্রামের মধ্যে ৩৪১৭টি গ্রামে নলকূপের জল আর্সেনিক পাওয়া গিয়েছে। আর্সেনিকের সমস্যাটা খুব অবস্থান-কেন্দ্রিক, এক গ্রামে সমস্যা আছে, পাশের গ্রামে নেই। তা হলে কয়েকটি গ্রামে আর্সেনিক পাওয়া গেলে পুরো ব্লকটিকে আর্সেনিক দূষণের আওতায় এনে চাষ বন্ধ করে দেওয়া কতটা ঠিক?
বাংলাদেশে গবেষণা-সূত্রে গ্রামে ঘুরে দেখেছি, যে-সব নলকূপে আর্সেনিক পাওয়া গেছে, সেগুলিকে লাল রং করা হয়েছে এবং কাছাকাছি জলস্তর দেখে আর্সেনিকমুক্ত জলের কল করা হয়েছে। ঘরে ঘরে গিয়ে সবাইকে বোঝানো হয়েছে যে, লাল কল থেকে জল না নিতে। আমাদের রাজে এমন তৎপরতা নজরে পড়েনি। যত দূর জানি, ব্লকে ব্লকে আর্সেনিক পরীক্ষা করার ল্যাব নেই। শুধু কি ভয় দেখালেই হবে, সমাধান খুঁজতে হবে না?\
কিছু নতুন গবেষণা বলছে, মাটিতে আর্সেনিকের মাত্রা খুব বেশি থাকলে খাদ্যের মাধ্যমেও শরীরে আর্সেনিক আসার একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে। আমরা কি গবেষণার মাধ্যমে এই সব জায়গাকে চিহ্নিত করে, কৃষকদের কাছে উপযুক্ত প্রযুক্তি আর জল ব্যবহারের ভাল পদ্ধতি পৌঁছে দিতে পারি না? এই নিয়েও কিন্তু প্রচুর গবেষণা হয়েছে এবং দেখা যাচ্ছে যে চাষের জলে আর্সেনিক মোকাবিলা করার অনেক ভাল পদ্ধতি আছে। সর্বত্র চাষ বন্ধ করাটা কি কোনও সমাধান? গবেষণা এটাও দেখাচ্ছে, যাদের শরীরে পুষ্টির অভাব, তাদেরই আর্সেনিক-ঘটিত রোগ বেশি হয়। গরিবের খাদ্যনিরাপত্তাও কি আর্সেনিকের সমাধান নয়?
বিদ্যুৎ না পেলে কৃষকরা ডিজেল দিয়ে চাষ করবেন। তাতে চাষের খরচ আরও বাড়বে, বাড়বে কৃষির সংকট, দারিদ্র, বাড়বে পরিবেশদূষণও। এ সব মাথায় রেখেই আমাদের জলস্তর ও জলদূষণের মতো সমস্যার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। তার জন্য প্রয়োজন তথ্য, সমাধান-মুখী গবেষণা, উপযুক্ত প্রযুক্তির ব্যবহার, সার্বিক সচেতনতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা। খাদ্য-নিরাপত্তা ও দারিদ্র-মোচনের মূল লক্ষ্য রেখে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টা, আসুন, এক সঙ্গে আলোচনা করি।

লেখক নয়াদিল্লিতে ‘ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট’ সংস্থার গবেষক।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.