মৌখিক ভাষণে কিংবা লিখিত বয়ানে নামের আগে ‘মহামহিম’ (হিজ এক্সেলেন্সি) কিংবা পদের আগে ‘মাননীয়’, ‘মান্যবর’ ইত্যাদি বিশেষণ ব্যবহারে আপত্তি জ্ঞাপন করিয়াছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। ললিতনারায়ণ মিথিলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি রূপে উপস্থিত থাকার আমন্ত্রণপত্রে এই মর্মে প্রযুক্ত বিশেষণগুলি সংশোধন করিতেও বাধ্য করিয়াছে রাষ্ট্রপতি ভবন। শুধু তাহাই নহে, বিশিষ্টদের জন্য অনুষ্ঠানমঞ্চে রাখা চেয়ারগুলি যেন একই রকম হয় আর মঞ্চারূঢ়দের সম্মুখস্থ টেবিলের উপর রাখা নামপত্রগুলিতেও যাহাতে পূর্বোক্ত বিশেষণগুলি না থাকে, সেই মর্মেও নির্দেশ দেওয়া হইয়াছে। ঔপনিবেশিক যুগের ঔপচারিকতার অবশেষগুলিকে রাজপুরুষরা সচরাচর বর্জন করার উদ্যোগ করেন না। নূতন রাষ্ট্রপতির তৎপরতা ব্যতিক্রমী বইকী।
ব্রিটিশ উপনিবেশের যুগে তাহার পূর্ববর্তী রাজতন্ত্রের পদমর্যাদা ও ক্রমোচ্চ শ্রেণিবিভাগ সংক্রান্ত ধারণা ও অনুশীলনগুলি পরিত্যক্ত তো হয়ই নাই, উপরন্তু সাম্রাজ্যবাদের রাজনৈতিক নৈতিকতা অনুযায়ী আরও সমৃদ্ধ ও সুচারু করিয়া তোলা হয়। পদের মর্যাদা যত উচ্চ, তাহার বিশেষণ ও ভূষণগুলিও তত গাল-ভরা, ধ্বনিমন্দ্রিত হইয়া ওঠে। গভর্নর জেনারেল কিংবা ভাইসরয়ের মতো সম্রাজ্ঞীর ঔপনিবেশিক প্রতিভূ তথা শীর্ষ প্রশাসনিক পদাধিকারীদের নামের আগে ‘মহামহিম’, ‘মান্যবর’, ‘মাননীয়’ ইত্যাদি সম্ভ্রমসূচক বিশেষণ ব্যবহৃত হইতে থাকে। সভাকক্ষে পদাধিকারীদের বসিবার চেয়ারগুলিও পদমর্যাদার ক্রম অনুসারে গদি-আঁটা, কারুকার্যখচিত এবং আরামদায়ক করিয়া তোলা হয়। কে কাহার উপরে কিংবা কে কাহার নীচে, তাহা স্পষ্ট করিয়া দেওয়াই ছিল এই শ্রেণিবিভাজনের লক্ষ্য। সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের স্বার্থে এই বিভাজন হয়তো জরুরি ছিল। কিন্তু ইহা প্রজাপুঞ্জের আত্মমর্যাদা, রুচি, শালীনতা ও শোভনতাকে আহত করিত। একই ভাবে আদালতে বিচারপতিকে ‘মাই লর্ড’ বলিয়া সম্বোধন করার রেওয়াজটিও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি হইতে আহরিত। স্বাধীনতার পঁয়ষট্টি বছর পরেও নানা ঔপনিবেশিক অভ্যাস যে চলিয়া আসিতেছে, তাহার কারণ বিনা প্রশ্নে এগুলি মানিয়া লওয়ার প্রবণতা।
ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি আধুনিক লগ্নিপুঁজির অনুষঙ্গ হইলেও সামন্ত রাজতন্ত্রের সাংস্কৃতিক চিহ্ন ও অভিজ্ঞানগুলি সম্পূর্ণ মুছিয়া ফেলিয়া সর্বদা আত্মপ্রতিষ্ঠা করে নাই, প্রায়শ সেগুলির সহিত আপস করিয়াছে। বিশেষত অন্য জাতীয়তা, ভাষাভাষী, ধর্ম ও সংস্কৃতির দেশে আপন প্রভাব বিস্তারের সময়। ভারতে মুঘল রাজতন্ত্রের অধিকাংশ চিহ্নই তাই ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা আত্মস্থ করিয়া লয় এবং ভারতীয় প্রজাপুঞ্জের উপর শাসন চালাইবার প্রাতিষ্ঠানিক উপচারগুলি সযত্নে লালন করে। দুই শতাব্দীর সেই যত্নশীল প্রতিপালনের পরিণাম যে স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রীয়-প্রশাসনিক প্রতীক ও চিহ্নগুলির গায়ে জড়াইয়া থাকিবে, তাহা আশ্চর্য নয়। ঔপনিবেশিক যুগের অনেক আইন এত কাল পরেও সংশোধিত হয় নাই, পূর্ব চেহারাতেই বহাল রহিয়াছে। রাষ্ট্রীয় প্রথা-প্রকরণ, বিচারবিভাগীয় রীতিপদ্ধতি এবং আমলাতান্ত্রিক আচরণবিধি ও প্রশাসনিক আদবকায়দায় উপনিবেশের অভ্যাসগুলিই এখনও অক্ষত। রাষ্ট্রপতির সাধুবাদ প্রাপ্য। |