ভারতীয় বামপন্থীরা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং মনমোহন সিংহের সহিত আরও একটি শত্রু পাইয়াছেন। তাঁহার নাম বিজয় কেলকর। তাঁহারা এই ‘ফাউ’টি গ্রহণ করিবেন কি না, সেটা তাঁহাদের বিবেচ্য, তবে ঈষৎ চেষ্টা করিলে বিজয় কেলকরের মুণ্ডপাত অভিযানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও পাশে পাইবেন। কেলকরের অপরাধ, তিনি ডিজেল এবং রান্নার গ্যাসের পাশাপাশি কেরোসিন, সার এবং রেশনের চাল-গমের দামও বাড়াইতে বলিয়াছেন, তৎসহ বলিয়াছেন খাদ্য নিরাপত্তার প্রস্তাবিত আয়োজনটি এক লপ্তে চালু না করিয়া পর্যায়ক্রমে করা ইউক। এমন ‘জনবিরোধী’ পরামর্শ দানের জন্য জনতার আদালতে কেলকরের কোন শাস্তি বিহিত হইবে, তাহা ভাবিলে হৃৎকম্প হওয়া স্বাভাবিক। তাঁহার প্রস্তাবগুলি রূপায়ণ করিতে নব্য-নির্ভীক মনমোহন সিংহ এবং তাঁহার তেজস্বী অর্থমন্ত্রী অকুতোভয়ে ঝাঁপাইয়া পড়িবেন, এমন আশাও কেহ করিতেছে না। সরকারি মুখপাত্ররা বরং আকারে ইঙ্গিতে বুঝাইয়া দিয়াছেন, এই সব প্রস্তাব কার্যকর করার আগে সরকার বিস্তর চিন্তাভাবনা করিবে, এগুলি প্রস্তাবমাত্র। অর্থাৎ, কেন্দ্রীয় সরকারও কেলকরের পরামর্শ হইতে নিজেদের সন্তর্পণে দূরে সরাইয়া রাখিতেছে। স্বাভাবিক। ডিজেল ও রান্নার গ্যাসের দাম বাড়াইয়া এবং রিটেল ব্যবসায় বিদেশি পুঁজিকে ছাড়পত্র দিয়া মনমোহন সিংহ ইতিমধ্যেই যথেষ্ট অগ্ন্যুৎপাত ঘটাইয়াছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজধানীতে ধর্নায় বসাইয়াছেন, এখনই আরও মূল্যবৃদ্ধির পথে হাঁটা তাঁহার পক্ষে কঠিন।
কিন্তু বিজয় কেলকর রাজনীতির হিসাব কষেন নাই। সেই হিসাব কষিবার কাজ তাঁহার ছিল না। কেন্দ্রীয় সরকার তাঁহাকে একটি নির্দিষ্ট দায়িত্ব দিয়াছিল। সরকারি আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য ফিরাইবার উপায় কী, সেই বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার দায়িত্ব। তিনি সেই দায়িত্ব পালন করিয়াছেন। তথ্য এবং পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে তিনি একটি হিসাব স্পষ্ট করিয়া দিয়াছেন। চলতি আর্থিক বছরের (২০১২-১৩) বাজেটে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় হিসাব দেখাইয়াছিলেন, রাজকোষ ঘাটতি, অর্থাৎ কার্যত নূতন সরকারি ঋণের অঙ্ক হইবে মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জি ডি পি) ৫.১ শতাংশ। কেলকরের হিসাবে, প্রণববাবুর জমা-খরচের খাতায় দুটি অঙ্কের সহিত বাস্তবের তারতম্য আছে। জমার দিকে সরকারি রাজস্ব যাহা ধরা হইয়াছিল, প্রকৃত রাজস্ব হইবে তাহা অপেক্ষা ৬০,০০০ কোটি টাকা কম। খরচের দিকে ভর্তুকির পরিমাণ হইবে বাজেটের তুলনায় ৭০,০০০ কোটি টাকা বেশি। সুতরাং রাজকোষ ঘাটতি বাজেটের তুলনায় ১,৩০,০০০ কোটি টাকা বাড়িয়া যাইবে। জি ডি পি-র অনুপাত হিসাবে ঘাটতি দাঁড়াইবে ৬.১ শতাংশ। কেলকরের সাফ কথা, এই গরমিল সামলাইয়া যদি রাজকোষ ঘাটতির মাত্রা বাজেটের আপন লক্ষ্যমাত্রাতেই ফিরাইতে হয়, কঠোর সিদ্ধান্ত অপরিহার্য। ইহা পাটিগণিত। পাটিগণিত রাজনীতি বোঝে না।
সরকারকে রাজনীতি বুঝিতে হয়। মনমোহন সিংহ রাজনীতির মোকাবিলা করিয়াই আয়-ব্যয়ের অঙ্ক মিলাইতে সচেষ্ট। কিছুটা সফলও। কিন্তু কেলকর কমিটির রিপোর্ট দেখাইয়া দিয়াছে, এখনও সমস্যা বিস্তর। ভর্তুকি ছাঁটাইয়ের পথে আংশিক অগ্রগতি হইয়াছে মাত্র। সারের ভর্তুকি কমানো অত্যন্ত জরুরি। সরকারি সংস্থার বিলগ্নিকরণ কত দূর সফল হইবে, বলা কঠিন। পরিকাঠামোয় সরকারি বিনিয়োগ অত্যাবশ্যক, কৃষিতেও। এই পরিপ্রেক্ষিতেই কেলকর সামাজিক ব্যয় সম্পর্কে সতর্ক হইতে বলিয়াছেন। সমস্ত দরিদ্রের জন্য খাদ্য নিরাপত্তার আয়োজন করিতে পারিলে অতি উত্তম, কিন্তু তাহার খরচ মিটাইবার সাধ্য সরকারের আছে কি না, সেই প্রশ্নকে সমাজতন্ত্রী স্লোগান বা জনপ্রিয় আদর্শের বাণী দিয়া প্রতিহত করা যাইবে না, তাহার সদুত্তর মিলাইতে হইবে জমা-খরচের খাতায়। |