এ যেন ক্ষতের স্মৃতি খোদাই করা।
এই রকমটা ভেবেই হাতে বিশেষ ধরনের উল্কি আঁকিয়েছিলেন ইজরায়েলি তরুণী এলি সাগির। সেটা প্রথম দেখান তাঁর ঠাকুর্দা ইয়োসেফ ডায়ামন্টকে। নাতনির হাতটা ছুঁয়ে থমকে গিয়েছিলেন বৃদ্ধ। তাঁর হাতেও যে এই একই উল্কি!
ফারাক শুধু একটাই। প্রায় ৭০ বছর আগে আউশভিৎসের ক্যাম্পে বন্দি ইয়োসেফের হাতে কয়েকটা সংখ্যা দেগে দিয়েছিল নাৎসি সেনারা। আর এলি সেটাই নিজের হাতে আঁকিয়েছেন ঠাকুর্দার সেই দুর্বিষহ স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে।
এলি একা নন। স্মৃতি-রক্ষার এই অভিযান ছড়িয়ে পড়েছে গোটা ইজরায়েল জুড়েই। আউশভিৎসের নাৎসি ক্যাম্পে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন যাঁরা তাঁদের পরিবারের তরুণ-তরুণীদের মধ্যেই এই ধরনের উল্কি আঁকানোর আগ্রহটা বেশি। নকশা বলতে কিছুই নেই। স্রেফ কয়েকটা সংখ্যা। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ওই সংখ্যাগুলিই তো ছিল বন্দি ইহুদিদের একমাত্র পরিচয়। সেই সংখ্যাগুলিকেই প্রতিবাদের মাধ্যম করেছে ইজরায়েলের নবীন প্রজন্ম।
এ নিয়ে একটি তথ্যচিত্রও তৈরি করেছেন ডানা ডোরোন নামে ইজরায়েলের এক চিকিৎসক। তাতে রয়েছে জনা পঞ্চাশ আউশভিৎস-ফেরত ইজরায়েলির সাক্ষাৎকার। ডোরোন জানাচ্ছেন, কেউ কেউ আজও তাঁদের হাতের সংখ্যাগুলোর জন্য যন্ত্রণায় কুঁকড়ে থাকেন। নিছক কিছু দাগ নয়, ওগুলো তাঁদের কাছে গভীর ক্ষত। ডোরোন নিজেও ওই সংখ্যাগুলিকে ক্ষত ছাড়া আর কিছু মনে করেন না। তিনিও এক আউশভিৎস-ফেরত ইহুদির সন্তান।
ইতিহাস বলছে, ১৯৪১ সালে প্রথমে আউশভিৎসের ক্যাম্পে এবং তার পরের বছরে বিরকেনোর ক্যাম্পে কয়েদিদের বুকে বা হাতে নম্বর দেগে দেওয়ার চল শুরু হয়। মুক্তির পরে যে দাগ বয়ে বেড়াতে হচ্ছে আজীবন।
সংখ্যা নিয়ে এ হেন প্রতিবাদে অবশ্য খুশি নন ইজরায়েলিদের একাংশ। কেউ কেউ মনে করেন, এতে নাৎসি-নির্যাতনের মতো বিষয়কে সস্তার ফ্যাশানে পরিণত করা হচ্ছে। আবার লস অ্যাঞ্জেলেসে আমেরিকান ইহুদি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক অধ্যাপক এই প্রতিবাদকে তরুণ প্রজন্মের হুজুগ ছাড়া কিছু ভাবতে রাজি নন। সমালোচনা আসছে প্রবীণ-মহল থেকেও। তাঁদের বক্তব্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প থেকে মুক্তি পাওয়ার পর কয়েদি নম্বর মুছতে অনেকে ইহুদিই ভিড় করেছিলেন শল্যচিকিৎসকদের কাছে। কেউ কেউ আবার ফুল হাতা জামা পড়তেন শুধুমাত্র নাৎসি-স্মৃতি লুকাবেন বলে। এ হেন ক্ষতের স্মৃতিকে উস্কে দেওয়া আদৌ কতটা যুক্তিযুক্ত?
তবে এলি সাগিররা দমবার পাত্র নন। তাঁদের একটাই বক্তব্য, নাৎসি-নির্যাতনের ইতিবৃত্ত কোনও ভাবেই যেন নিছক ইতিহাসের ঘটনা হয়ে না থাকে। বরং সেই ইতিহাস যেন বর্তমান, এমনকী ভবিষ্যৎ প্রজন্মও অনুভব করতে পারে, সে জন্যই তাঁরা বহন করতে চান ক্ষত-স্মৃতি। নাৎসি-সন্ত্রাসের ইতিহাসকে প্রশ্ন করার অধিকার ও প্রতিবাদের স্পর্ধাকে কোনও মতেই খোয়াতে চান না ইয়োসেফ ডায়ামন্টদের উত্তরপুরুষ। |