ইতিহাসের বই তো অনেকেই লেখেন। লেখেন রাজা-রাজড়া ও বিশ্ব রাজনীতির তাবড় নেতার কাণ্ডকারখানা, যুদ্ধবিগ্রহ, বিপ্লব আর সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে সে সবের চুলচেরা বিশ্লেষণ। কিন্তু সাধারণ ছা-পোষা, খেটে খাওয়া জনতার জীবনে এত সব দুনিয়া-কাঁপানো ঘটনার কী প্রভাবটা পড়ল, তা পাতার পর পাতা লিখতে বসেন কোনও পণ্ডিত? ঠিক এই বিরল দৃষ্টির কৃতিত্বটাই এরিক হবসবমকে দিতেন তাঁর ভক্তরা। আজ ভোরে লন্ডনের হাসপাতালে এই ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ৯৫ বছর বয়সে প্রয়াত হওয়ার পর সেই কথাই আবার বলছেন তাঁরা। লেবার পার্টির নেতা এড মিলিব্যান্ডের প্রতিক্রিয়া, “গজদন্তমিনার থেকে সাধারণ মানুষের জীবনে ইতিহাসকে নামিয়ে এনেছিলেন তিনি।”
তিনি, এরিক জন আর্নেস্ট হবসবম। বামপন্থী ঘরানার উজ্জ্বলতম ইতিহাসবিদদের অন্যতম। যাঁর গবেষণায় গভীর ভাবে প্রভাবিত ভারত-সহ সারা দুনিয়ার ইতিহাসবিদ ও রাজনীতিবিদদের কয়েকটা প্রজন্ম। লন্ডনে গেলেই সাধারণত যাঁর সঙ্গে দেখা করে আসতেন প্রকাশ কারাট-সীতারাম ইয়েচুরিরা। তিনিই ইতিহাসের সেই গল্পকার, বিখ্যাত ‘চার অধ্যায়ে’ যিনি ধরে রেখেছেন ফরাসি বিপ্লব থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন।
হবসবমের সেই চার অধ্যায় চারটি বিখ্যাত বই। সব চেয়ে বেশি পঠিত ও চর্চিত ইতিহাসের বইগুলোর মধ্যে থাকবে সালের ক্রমপর্যায় অনুযায়ী সাজানো এই চারটি গ্রন্থ ‘দ্য এজ অফ রেভলিউশন: ইউরোপ ১৭৮৯-১৮৪৮’, ‘দ্য এজ অফ ক্যাপিটাল: ১৮৪৮-১৮৭৫’, ‘দ্য এজ অফ এম্পায়ার: ১৮৭৫-১৯১৪’ এবং ‘দ্য এজ অফ এক্সট্রিমস: দ্য শর্ট টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি, ১৯১৪-১৯৯১’। ইতিহাসবিদ নিয়াল ফার্গুসনের মতে, “কেউ আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাস পড়া শুরু করতে চাইলে এর চেয়ে ভাল সংকলন হয় না।”
আসলে হবসবমের জীবনটাই যেন এক ঐতিহাসিক যাত্রা। আলেকজান্দ্রিয়ায় এক ব্রিটিশ ইহুদি পরিবারে জন্ম ১৯১৭-র ৯ জুন। বাবা-মাকে শৈশবেই হারানোর পর ১৯৩১ থেকে ঠিকানা হয় বার্লিন। হিটলার যে বছর ক্ষমতায় আসেন, সেই ১৯৩৩-এই বার্লিনের পাট চুকিয়ে তিনি চলে আসেন লন্ডনে। ক্রমশ কেমব্রিজে পড়াশোনা, ১৯৪৭-এ বার্কবেক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কয়েকটা দশক পরে সেখানকারই প্রেসিডেন্ট।
মার্ক্সবাদের পোকা অবশ্য মাথায় ঢুকেছিল বার্লিনে থাকতেই। লন্ডনে আসার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশ সেনার ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিটে কাজ করেন কিছু দিন। খেটে খাওয়া সমাজের সঙ্গে পরিচয় হয় এই সময়টাতেই। জড়িয়ে পড়েন অধুনালুপ্ত ‘কমিউনিস্ট পার্টি অফ গ্রেট ব্রিটেন’-এর সঙ্গে। পরবর্তী কালে তিনি ‘কমিউনিস্ট পার্টি ঐতিহাসিক লেখক গোষ্ঠী’রও অন্যতম পুরোধা হয়ে ওঠেন। শুধু ব্রিটেন নয়, গোটা দুনিয়ার কমিউনিস্ট আন্দোলন নিয়ে আগ্রহ ছিল আজীবন। ভারতের বাম নেতারা লন্ডনে দেখা করতে গেলে গেলে জানতে চাইতেন কাজকর্মের হাল-হকিকত।
সেই সূত্রেই এক বার নেমে এসেছিল এক অযাচিত বিতর্ক। ২০১০-এ একটি ব্রিটিশ পত্রিকাকে সাক্ষাৎকারে হবসবম বলেন, ২০১১-এর বিধানসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম খুব খারাপ ফল করতে পারে বলে প্রকাশ কারাট তাঁর কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। “কারাট বলেছেন, তাঁরা নিজেদের কোণঠাসা মনে করছেন”, বলেছিলেন তিনি। সেই সাক্ষাৎকার নিয়ে জলঘোলা হয় যথেষ্ট। মুখরক্ষায় বিবৃতি দিতে হয় কারাটকে। হবসবমও পরে জানান, কারাট শুধু তাঁকে বলেছিলেন, মাওবাদী ও অন্যান্য দলের আক্রমণের শিকার হচ্ছে সিপিএম। দল যে ভোটে হারবে, তেমন কোনও কথা তিনি বলেননি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য নজিরবিহীন বিপর্যয়ে বাম-বিদায়ই ঘটে পশ্চিমবঙ্গে। বাম সরকারের জমি-অধিগ্রহণ নীতির কুপ্রভাব নিয়ে ওই সাক্ষাৎকারেই উদ্বেগ জানিয়েছিলেন হবসবম।
গুণমুগ্ধরা বলেন, ইতিহাসের পুঁথিপত্রের বাইরেও দেশের রাজনৈতিক অভিমুখ নিয়ে ভাবতেন হবসবম। সমাজের সঙ্গে ব্রিটেনের লেবার পার্টির নিজেকে বদলাতে না পারা নিয়ে সমালোচনায় মুখর হয়েছিলেন এক সময়। অনেকের মতে, টনি ব্লেয়ারদের ‘নব্য লেবার’-এর জন্মের পিছনে সেই সমালোচনার ভূমিকা যথেষ্টই।
সেই দিশারি, ইতিহাসকার এখন নিজেই ইতিহাস। |