শিলচরের মানুষের বড় আক্ষেপ, শিলচরে ডাক্তার দেখানো তাঁদের কাছে প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। অধিকাংশ ভাল ডাক্তারের চেম্বারে গেলেই বিপদগ্রস্ত শিলচরবাসীকে শুনতে হচ্ছে, “আজ তো হবে না। কাল ভোরে এসে নাম লেখান।” শিলচরবাসীদের ক্ষোভ, ভোর তিনটে থেকেই তো লাইন ধরে নিচ্ছে ত্রিপুরার রোগীরা। লাইনে তো ঠাঁই নাই।
আগরতলা সুভাষনগরের কমল রায় কানের ডাক্তার দেখাতে শিলচর আসছেন। সিদ্ধি আশ্রমের গোপা বিশ্বাসও চড়ে বসেছেন শিলচরের ট্রেনে। অনেক দিন থেকে কোমরে ব্যথা তাঁর। একই উদ্দেশে শিলচরের ট্রেন ধরেছেন তেলিয়ামুড়ার প্রদীপ দেববর্মা। তিনি যাবেন মণিপুরের জিরিবামে। সেখানেই চেম্বার তাঁর ডাক্তারের।
রেলসূত্রে জানা গিয়েছে, আগরতলা-সহ ত্রিপুরার বিভিন্ন স্টেশন থেকে প্রতিদিন সাত থেকে আটশো লোক শিলচরে আসেন। তাঁদের সত্তর শতাংশ আবার প্ল্যাটফর্মেই রাত কাটান। ভোর হওয়ার আগে বেরিয়ে পড়েন, ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে লাইন ধরেন। ত্রিপুরার রোগীদের মধ্যে রিকশাচালক-দিনমজুররা যেমন রয়েছেন, তেমনই আছেন অধ্যাপক-ইঞ্জিনিয়ার, পদস্থ সরকারি কর্তারাও।
কেন তাঁরা চিকিৎসার জন্য শিলচর বা জিরিবামে ছুটে আসছেন? কেন অনেকে আবার যান ভেলোর কি কলকাতায়? তবে কি নিজের রাজ্যের চিকিৎসায় আস্থা নেই মানুষের?
ত্রিপুরার স্বাস্থ্যমন্ত্রী তপন চক্রবর্তীর কথায়, “আস্থার ব্যাপারটা আপেক্ষিক। কারও বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করানোর ক্ষমতা থাকলে তিনি যদি বাইরে যেতে চান, তা হলে তাঁকে আটকে রাখা যাবে?” তাঁর কথায়, স্বাস্থ্য পরিষেবা এমনই যে, এর কোনও ঊর্ধ্বসীমা নেই। দিল্লি-মুম্বইয়ের লোকেরাও অনেকেই আমেরিকা-ব্রিটেনে ছোটেন ডাক্তার দেখাতে। তার মানে কি ভারতীয় ডাক্তাররা খারাপ?পাল্টা প্রশ্ন তপনবাবুর। তপনবাবুর বক্তব্য, “বিদেশে ভারতের ডাক্তারদের বড় নামডাক। ৬০ হাজারের বেশি ভারতীয় ডাক্তার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন।” তাঁর দাবি, ত্রিপুরার স্বাস্থ্য পরিকাঠামো মজবুত ভিতের উপরই দাঁড়িয়ে রয়েছে। জন্মহার, মৃত্যুহার, শিশু বা প্রসূতির মৃত্যু, গড় আয়ুসব ক্ষেত্রেই ত্রিপুরা উত্তর-পূর্বের অন্য রাজ্যের তুলনায় ভাল জায়গায় রয়েছে।
এখন ত্রিপুরাতে আটশোরও বেশি চিকিৎসক রয়েছেন। দু’টি মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস পড়ানো হচ্ছে। আগরতলা মেডিক্যাল কলেজে ১৩টি বিষয়ে এমডি পাঠ্যক্রমও চলছে। ত্রিপুরা মেডিক্যাল কলেজেও এমডি পাঠ্যক্রমে শীঘ্রই ভর্তি শুরু হবে। আগামী তিন বছরে ত্রিপুরার স্বাস্থ্যচিত্র অনেকটাই বদলে যাবে বলে দাবি করছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
কী ভাবে? তপনবাবুর ব্যাখ্যা, প্রতিটি পঞ্চায়েতে সাব-সেন্টার তৈরির লক্ষ্য নিয়ে অনেক দিন থেকে কাজ চলছে এখানে। আশি শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়া, জাতীয় মানদণ্ড যেখানে ৪০ হাজার লোকের জন্য একটি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রয়োজন সেখানে ত্রিপুরার উপজাতি এলাকায় প্রতি ১৫ হাজারে একটি এবং অন্যান্য এলাকায় ২৫ হাজারে একটি হিসেবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র নির্মাণের কাজ হচ্ছে। ২০১৩ সালের মধ্যে ১০ শয্যাবিশিষ্ট এই ধরনের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংখ্যা দাঁড়াবে ১৩০। পাশাপাশি, প্রতিটি ব্লকে তৈরি হচ্ছে ৩০ শয্যার কমিউনিটি হেল্থ সেন্টার। প্রতিটি মহকুমা সদরে থাকবে ১০০ শয্যার হাসপাতাল।
তবে কি তিন বছর পর বাইরে যাওয়া রোগীস্রোত কমে যাবে? আগরতলা মেডিক্যাল কলেজের এক কর্মী প্রশ্নটি শুনে হেসে উঠলেন। তাঁর কথায়, “ডিগ্রি বলুন আর পিজিআগরতলার চিকিৎসকরাই পড়ান মেডিক্যাল কলেজগুলিতে। বাইরের যে-ক’জন অধ্যাপক রয়েছেন, তাঁদের কেউই এখানে থাকেন না। ক্লাস সেরে বিমানে ফিরে যান। তাঁর কথায়, “বাইরের নামী-দামি ডাক্তার-অধ্যাপকরা এখানে থেকে পড়াবেন, রোগী দেখবেন, তবেই না মানুষের আস্থা বাড়বে।” আর আগরতলার আস্থা ফিরলে, স্বস্তি ফিরবে শিলচরের মানুষের। ‘লাইন ধরার’ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি! |