বাচ্চাগুলোর চোখে পাওয়ার রয়েছে। কিন্তু তা চিহ্নিত হচ্ছে না। বছরের পর বছর তারা বিনা চশমাতেই থাকছে। তার পর এক সময়ে তাদের চোখ চিরকালের জন্য ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। তখন আর চশমা দিয়েও তা ঠিক করা যাচ্ছে না। পরবর্তী কালে এদের অনেককেই হয়তো অন্ধত্বের অন্ধকারে ডুবে যেতে হবে। সরকারি চিকিৎসকদের এক সমীক্ষাতেই দেখা গিয়েছে, গ্রামেগঞ্জে নয়, খোদ কলকাতায় স্কুলপড়ুয়া বহু শিশুকে এই অবস্থার মধ্যে পড়তে হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের অন্ধত্ব নিবারণের জাতীয় কর্মসূচি রয়েছে, তাতে স্কুলে শিশুদের চোখ পরীক্ষা ও দরকারে বিনা পয়শায় চশমা দেওয়ার কথা। কিন্তু কলকাতারই অনেক স্কুলে কোনও দিন স্বাস্থ্য দফতর থেকে চোখ পরীক্ষা করা হয়নি বলেও অভিযোগ। ঠিক সময়ে চশমা না পেয়ে বেশ কিছু শিশুর চোখের দৃষ্টি চিরকালের মতো ঝাপসা হয়ে গিয়েছে, যাকে চিকিৎসা পরিভাষায় বলা হয় ‘অ্যামব্লাইয়োপিয়া।’ কোনও চিকিৎসা বা কোনও চশমাতেই আর তা ঠিক হওয়ার নয়।
কিছুদিন আগেই ‘ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ পাবলিক হেলথ্’-এ এই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। রিপোর্টে সরকারি চিকিৎসকেরাই সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছেন ‘বিশেষ করে রাজ্যের যে সব স্কুলে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছাত্রছাত্রীরা পড়ে সেখানে চোখ পরীক্ষা কর্মসূচি কী রকম চলছে, তা নজরদারির সময় এসেছে।’
কলকাতায় পুরসভা পরিচালিত ১০টি প্রাথমিক স্কুলে সমীক্ষা চালিয়েছিলেন ‘রিজিওন্যাল ইনস্টিটিউট অফ অপথ্যালমোলজি’ বা আরআইও-র চিকিৎসক সম্বুদ্ধ ঘোষ, আরআইও-র প্রাক্তন অধিকর্তা গৌতম ভাদুরি এবং স্বাস্থ্য দফতরের উপ-সহ স্বাস্থ্য অধিকর্তা (জনস্বাস্থ্য) দীপঙ্কর মাজি। এই স্কুলগুলির ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যাগরিষ্ঠই নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসা। ৬-১৪ বছরের মোট ২৫৭০ জন ছাত্রছাত্রীকে পরীক্ষা করে ৩৭৭ জনের (অর্থাৎ ১৪.৭%-এর) চোখে পাওয়ার (রেফ্র্যাকটিভ এরার) পাওয়া গিয়েছিল। এদের প্রত্যেকেরই চশমা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু চশমা ছিল মাত্র ৪ জনের!
স্কুল সূত্রেই জানানো হয়েছে, স্বাস্থ্য দফতর বা পুরসভা থেকে কোনও দিনই তাদের ছাত্রছাত্রীদের চোখ পরীক্ষা বা চশমা দেওয়ার ব্যবস্থা হয়নি। ঠিক সময়ে চশমা না-পাওয়ায় ‘অ্যামব্লায়োপিয়া’ বা চিরকালের জন্য চোখে দৃষ্টিশক্তি ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল ১৮ জন শিশুর। বাকি ২৫৫ জনের ক্ষেত্রেও ৯ বছর বয়সের মধ্যে চশমা না-পেলে একই দশা হওয়ার আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকেরা।
তা সত্ত্বেও কিন্তু স্বাস্থ্য দফতর জানিয়ে দিয়েছে, তাদের এত চিকিৎসক বা অপথ্যালমিক অ্যাসিস্ট্যান্ট এখনও নেই যাঁদের দিয়ে সব স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের চোখ পরীক্ষা করা যায়। স্বাস্থ্য দফতরের মুখপাত্র অসিত বিশ্বাসের কথায়, “কলকাতায় এক-একটি মেডিক্যাল কলেজের সঙ্গে ১০-১২টি স্কুলকে জুড়ে দেওয়া আছে। ওই স্কুলগুলিতে বছরে দু’বার ওই মেডিক্যাল কলেজ থেকেই চোখ পরীক্ষা করার কথা। কিন্তু মেডিক্যাল কলেজগুলিতে অন্যান্য কাজের চাপ, চিকিৎসক ও টেকনিশিয়ানের অপ্রতুলতায় তা সম্ভব হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে পুরসভাকে এগিয়ে আসতে হবে।” আর পুরসভার মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষ বলছেন, “এই রকম কোনও চোখ পরীক্ষা কর্মসূচির কথা আমাদের জানা নেই। এগুলো স্বাস্থ্য দফতরের ব্যাপার। পুরসভার এমন কোনও কর্মসূচি ছিল না, ভবিষ্যতে করার পরিকল্পনাও নেই।”
তা হলে জাতীয় অন্ধত্ব নিবারণ কর্মসূচির স্বার্থকতা কী রইল? অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা শিশুদের চোখ কী তা হলে অবহেলিতই থাকবে? উত্তর মেলেনি। স্বাস্থ্য দফতরের পরিসংখ্যান কিন্তু বলছে, স্কুল আই স্ক্রিনিং প্রোগ্রামে ২০১০-১১ সালে রাজ্যে মোট ৫৩৯৬১ স্কুলপড়ুয়ার চোখে পাওয়ার ধরা পড়ে। এদের সকলের চশমা দরকার। কিন্তু পেয়েছিল মাত্র ২৭৫৯৪ জন। ২০১১-১২ সালে পাওয়ার ধরা পড়েছিল ৮০৫৯২ জন স্কুলপড়ুয়ার। অথচ চশমা পেয়েছিল মাত্র ৩৮৭৬১ জন।
যারা সময় মতো চশমা পেল না, তাদের কী হবে? চক্ষু চিকিৎসক শৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “তাদের চোখের দৃষ্টি পাকাপাকি ভাবে ক্ষীণ বা ঝাপসা হয়ে যেতে পারে। এতে পরবর্তী কালে কাজ বা অনেক চাকরির ক্ষেত্রে তারা সমস্যায় পড়বে।”
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভারতে প্রতি বছর যত শিশু অন্ধ হয়, তাদের ৩৩.৩ শতাংশের ক্ষেত্রে অন্ধত্বের কারণ হল ঠিক সময়ে পাওয়ার চিহ্নিত না-হওয়া। চক্ষু চিকিৎসক হিমাদ্রী দত্ত বলেন, “ওই শিশুদের ‘লেজি আই’-এর সমস্যা হবে। অর্থাৎ তার দৃষ্টিশক্তি পাকাপাকি ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে। ভবিষ্যতে কখনও ঠিক হবে না। অনেকে ট্যারাও হয়ে যাবে।” |