দু’-দু’বারের বিজ্ঞাপন কার্যত নিষ্ফলা। পশ্চিমবঙ্গের নতুন সরকার এখনও একটিও বেসরকারি সংস্থাকে নিজেদের শর্তে রাজি করিয়ে তাদের দিয়ে পথে বাস নামাতে পারেনি। এ জন্য আঙুল উঠছে সরকারের দেওয়া কিছু ‘অবাস্তব’ শর্তাবলির দিকে। যার সূত্র ধরে বাস-বাণিজ্যে অভিজ্ঞ সংস্থার একাংশ রাজ্য সরকারের ‘সদিচ্ছা’ নিয়েই প্রশ্ন তুলছে।
সব মিলিয়ে সূচনার আগেই মুখ থুবড়ে পড়তে চলেছে কর্পোরেট বাস চালানোর নতুন প্রকল্প।
সরকারি পরিবহণ নিগমের ভর্তুকি-নির্ভরতা কাটাতে পরিবহণে অভিজ্ঞ বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে মহানগরে বাস চালানোর প্রক্রিয়া এ রাজ্যে শুরু হয়েছে পূর্বতন বাম জমানায়, কিছু বাতানুকূল বাসের মাধ্যমে। এই ‘কর্পোরেট বাস পরিষেবা’কে কলকাতা ও আশপাশে আরও ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে তৃণমূল সরকার। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বেসরকারি লগ্নিকারীদের উপরে এমন কিছু শর্ত তারা আরোপ করেছে, যার জেরে পরিকল্পনাটির ‘অকালমৃত্যুর’ আশঙ্কা করছে লগ্নিকারী ও সরকারি মহলের একাংশে। কী রকম?
পশ্চিমবঙ্গে পরিবহণশিল্পে বিনিয়োগে ইচ্ছুক একাধিক সংস্থার অভিযোগ, ‘কর্পোরেট’ বাস কোন রুটে চলবে, এবং যাত্রিভাড়া কী হবে, সে সব নির্ধারণের ক্ষমতা তাদের না-দিয়ে সরকার নিজের হাতে রেখেছে। এতেই অশনি সঙ্কেত দেখছে তারা। কারণ, বার বার জ্বালানি-মূল্য বাড়লেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার বাসভাড়া বাড়ায়নি। ফলে বহু বেসরকারি বাস বসে গিয়েছে, এমনকী ভাড়াবৃদ্ধির দাবিতে সম্প্রতি তিন দিন ধর্মঘট করেছেন বাস-মালিকেরা।
এতে লগ্নিকারীদের কাছে বিলক্ষণ ভুল বার্তা গিয়েছে বলে পরিবহণ দফতরের কর্তাদের অনেকেও স্বীকার করছেন। তাঁদের এক জনের কথায়, “সম্প্রতি ডিজেলের দাম পাঁচ টাকা বাড়ার পরেও সরকার বাসভাড়া বাড়ানোর ব্যাপারে এখনও উচ্চবাচ্য করছে না। এই অবস্থান সরকারের নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করেছে।” |
এবং এরই প্রতিক্রিয়ায় ‘কর্পোরেট বাস পরিষেবা’ প্রকল্পে সামিল হওয়ার ডাকে বিশেষ সাড়া মিলছে না বলে পরিবহণ-কর্তাদের একাংশের দাবি। আপাতত যে একটিমাত্র সংস্থা কলকাতায় এই পরিষেবা চালাচ্ছে, তারা লগ্নি করতে এসেছিল বামফ্রন্টের আমলে। এবং সংস্থা-সূত্রের খবর, ভাড়া-বিতর্কের জেরে তারাও রাজ্যের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো নিয়ে দ্বিধায় রয়েছে। রাজ্যের ‘বিনিয়োগ-বন্ধু’ ভাবমূর্তির খাতিরে তাদের ধরে রাখতে পরিবহণ-কর্তাদের কেউ কেউ উদ্যোগী হলেও সাফল্যের ইঙ্গিত এখনও নেই। বরং রাজ্যের ‘শর্ত’ দেখে একটি সংস্থার কর্তার আক্ষেপ, “বাস চালাব আমরা, অথচ ভাড়া, রুট সরকার বেঁধে দেবে! এ হয় নাকি!” তাদের দাবি, “রুটের ভিত্তিতে ভাড়া নির্ধারণের ক্ষমতা আমাদের হাতে ছাড়তে হবে। আমরা লাভ করতে এসেছি। ক্ষতি করে তো ব্যবসা করতে পারব না!”
পাশাপাশি ডিপো তৈরির শর্তেও ওঁরা বিভ্রান্ত। শর্তে বলা হয়েছে, প্রতি সংস্থাকে অন্তত ৫০টি বাস চালাতে হবে। আর সেই সব বাস রাখার জন্য ডিপোর ব্যবস্থা করতে হবে তাদেরই। কিন্তু অত বাস রাখার মতো ডিপো তৈরির জমি শহর-শহরতলিতে মিলবে কোথায়?
সরকারি তরফে সে সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। ফলে জমি-সমস্যার কথা ভেবেও আগ্রহীদের উৎসাহে ভাটার টান। এক সংস্থার কর্তা বলছেন, “পঞ্চাশটা বাস রাখতে হলে এক একরেরও বেশি জমি দরকার। আমাদের পক্ষে তা জোগাড় করা কঠিন। বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে।” উল্লেখ্য, কলকাতায় এখন ‘কর্পোরেট’ বাস চালানো সবেধন নীলমণি সংস্থাটি বাস রাখার জন্য মোটা টাকায় সরকারি পরিবহণ নিগমের গ্যারাজ ভাড়া করেছে।
দফতর-সূত্রের খবর: নতুন দফায় ‘কর্পোরেট বাস’ চালাতে রাজ্য প্রথম বিজ্ঞাপন দিয়েছিল চলতি বছরের গোড়ায়। সাড়া দিয়েছিল মাত্র তিনটি সংস্থা। দু’টি এখনও বাস নামাতে পারেনি, কারণ রাজ্যের সব শর্ত তারা পূরণ করতে পারেনি। কথা ছিল, তৃতীয় সংস্থাটি পুজোর আগে কয়েকটা বাস নামাবে। কিন্তু ভাড়া নিয়ে টানাপোড়েনের জেরে তা-ও আপাতত বিশ বাঁও জলে। “সাধারণ বাসের মতো ভাড়া থাকলে আমাদের লাভ হবে না। বাস চালাব কেন?” সাফ বলছেন সংস্থাটির এক কর্তা। উপরন্তু সরকারের শর্ত হল, অন্তত ২০% বাস হতে হবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। সে ক্ষেত্রে জ্বালানির দামের সঙ্গে মানানসই ভাড়া না-হলে এসি বাস চালানোর প্রশ্নই উঠছে না বলে লগ্নিকারীরা মনে করছেন।
এই পরিস্থিতিতে গত অগস্টে পরিবহণ দফতর ফের বিজ্ঞাপন দেয়। আবেদন জমার শেষ তারিখ ছিল ১৪ সেপ্টেম্বর। দফতরের খবর, ছ’টি আবেদন মিলেছিল। এদের একটি সংস্থা বিধিবদ্ধ টাকা জমা না-দেওয়ায় বাতিল হয়ে গিয়েছে।
পরিবহণ-কর্তাদের অনেকের ধারণা, বাকি পাঁচটার মধ্যে বাস নামাতে পারবে বড়জোর একটা বা দু’টো সংস্থা। “সরকারের চাইছে যত বেশি সম্ভব কর্পোরেট বাস রাস্তায় নামাতে। কিন্তু আবেদনে সাড়ার যা বহর, তাতে সরকারের সিকিভাগ ইচ্ছেপূরণও হবে কি না সন্দেহ।” মন্তব্য মহাকরণের এক আমলার।
অর্থাৎ ‘কর্পোরেট’ বাসের চাকা কবে ঘুরবে, কেউ জানে না। |