দুই জিবির মাইক্রোচিপে রেকর্ড করা তেরো অধ্যায়ের সম্পূর্ণ চণ্ডী পাঠ। তা দেওয়া হচ্ছে পুরোহিতদের। বিশেষ করে নতুন পৌরোহিত্যে এসেছেন, এমন নবীনদের। নির্দেশ হল, প্রতিদিন বাড়িতে কম করে দু’ঘণ্টা ওই চণ্ডীপাঠ শুনতে হবে। নিজে পাঠ করতে হবে সেই মতো। বারবার এমন করতে করতে বিশুদ্ধ উচ্চারণে চণ্ডীপাঠ করতে শিখে যাবেন তাঁরা।
বঙ্গীয় পুরোহিত সভার নবদ্বীপ শাখা এই পদ্ধতিই নিয়েছেন দুর্গাপুজোর সময় পুরোহিতের চাহিদা মেটাতে। ওই সভার পক্ষে জানানো হয়েছে, এমনিতে পৌরোহিত্যর পেশা হিসেবে তেমন চাহিদা নেই। তাই এই পেশায় কেউ থাকতে চান না। কারণ সারা বছর ধরে তেমন কোনও পুজোও হয় না, যেখানে পৌরোহিত্য করে সংসার চালানো যায়। তাই সকলেই অন্য কোনও কাজ করতে চান। কিন্তু সমস্যা হল দুর্গাপুজোর সময়ে পুরোহিতের চাহিদা হু হু করে বেড়ে যায়। বাড়ির পুজো, বারোয়ারি পুজো মিলিয়ে এখন যে কোনও জনপদেই প্রায় পাড়ায় পাড়ায় পুজো হচ্ছে। তখন এক সঙ্গে অনেকগুলো দিক সামলাতে হয়। প্রথমত, পুরোহিতেরই অভাব। দ্বিতীয়ত, যাঁরা পৌরোহিত্য করেন, তাঁদের পক্ষেও এত বড় একটা পুজো সামলানো বেশ শক্ত। তৃতীয়ত, এই পুজো বাঙালির আবেগের সঙ্গে এমন ভাবেই জড়িত যে, তাতে ছোট্ট কোনও খুঁত থাকলেই মন খুঁতখুঁত করে। অতএব, দরকার দ্রুত প্রশিক্ষিত পুরোহিতের সংখ্যা বাড়িয়ে নেওয়া। কিন্তু সেখানে সমস্যা হল, যেহেতু দুর্গাপুজোর মতো বড় উৎসব বছরে একটাই হয়, তাই তার জন্য দীর্ঘ প্রশিক্ষণ নিতে পুরোহিতদের খুব একটা আগ্রহ থাকে না। অন্য পেশায় চলে যাওয়ায় তাঁরা সেই প্রশিক্ষণ নেওয়ার মতো সময়ও পান না। সমস্যা মেটাতে তাই দরকার চটজলদি ব্যবস্থা আর তাতেই বাজিমাৎ করে দিয়েছে চণ্ডীর এই ছোট্ট চিপ। কেননা, চণ্ডীপাঠই এই পুজোর সব থেকে আবেগদীপ্ত দিক।
ওই সভার নবদ্বীপ শাখার সম্পাদক সুশান্তকুমার ভট্টাচার্য বলেন, “মোবাইল ফোন এখন সকলেরই রয়েছে। আর তাতে মেমরি কার্ড নেই, এমনটাও দেখা যায় না। তাই চণ্ডীর পাঠ চিপে করে দিয়ে দিচ্ছি। যে যার সময় মতো শুনে নেবেন। সেই মতো পাঠ অভ্যাসও করবেন।” তাঁর কথায়, “মোবাইলে থাকলে সুবিধা হচ্ছে, যার যখন ইচ্ছে, তিনি তখন সেই অংশটাই শুনে নিতে পারছেন। প্রতিটি অধ্যায় আলাদা আলাদা করে রেকর্ড করা হয়েছে।” তাতে তাঁর পাঠাভ্যাসও হয়ে যাচ্ছে। সুশান্তকুমারবাবু বলেন, “প্রয়োজনে কেউ কানে ইয়ারফোন গুঁজে চণ্ডীপাঠ শুনে নিতে পারবেন। অন্য কাজ করতে করতেও শুনতে পারবেন। তাতে পুরো বিষয়টি মনে গেঁথে যাবে।” সেই সঙ্গেই তাঁর বক্তব্য, “এই রোজ রোজ চণ্ডীপাঠ শোনার অভ্যাসটা পুরোহিতের মনও তৈরি করে দেবে। সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
তবে কেবল তাতেই ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে না। পুরোহিতদের শিবিরও করা হবে। প্রবীণ শাস্ত্রজ্ঞ সত্যনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “প্রতিবারই দুর্গাপুজোকে ঘিরে কিছু না কিছু সমস্যা তৈরি হয়। সেগুলো শাস্ত্র মতে সমাধান করতে না পারলে বিতর্ক এড়ানো সম্ভব নয়।” যেমন, এ বার দুর্গাপুজো কার্তিকে। কিন্তু পুজোর সংকল্পের মন্ত্রটিতে আশ্বিনের শুক্ল পক্ষের কন্যা রাশির কথা রয়েছে। এ বার কী বলা হবে? আবার, বোধনের কল্পারম্ভ সাত রকম। কোন কল্পারম্ভ অনুসরণ করবেন পুরোহিত?
সত্যনারায়ণবাবু বলেন, “এই জন্যই শিবিরের প্রয়োজন। দেবীপুরাণ, বৃহৎনন্দীকেশর এবং বৈদিক পুজাপ্রকরণ। সবার উপরে স্মার্ত রঘুনন্দনের দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী। এই সব প্রামাণ্য বইগুলির উপরে নির্ভর করেই আমরা সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। এ বারও শিবিরে সেই ভাবেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হবে।”
সংস্কৃতের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এবং সংস্থার প্রধান উপদেষ্টা কুমারনাথ ভট্টাচার্য বলেন, “ভালো করে পৌরোহিত্য করতে গেলে সংস্কৃত ব্যাকরণ শিখতেই হবে। বিশেষ করে বচন, লিঙ্গ এ সব বিষয়ে সম্যক ধারণা না থাকলে ভুল মন্ত্র উচ্চারণ করা হবে। তাতে পুজো অসিদ্ধ। তাই আমরা দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে সংস্কৃত ব্যাকরণ পাঠও করানোর চেষ্টা করছি।”
কমবেশি জনা পঞ্চাশেক নানা বয়সের পুরোহিত নিয়ে রবিবার নবদ্বীপের রানি রাসমণির কাছারিবাড়ির সভা ঘরে শুরু হয়েছে এই শিবির। সুশান্তকুমারবাবু বলেন, “এখন পুরোহিতের জন্য অর্থব্যয় করতে কেউ কুণ্ঠিত হন না। কিন্তু ভাল পুরোহিত পাওয়া শক্ত। আমরা সেই অভাবটাই মেটাতে চাই।” |